নিয়োগপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে

সম্পাদকীয়

দেশে যখন একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে, তখন জনগণের করের অর্থে পরিচালিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নির্বিকার থাকা কেবল হতাশাজনক নয়, উদ্বেগজনকও। গত সোমবার মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, যে প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে, যে প্রতিষ্ঠানে দলীয় আনুগত্যের বাইরে কাউকে নেওয়া হয় না, সেই প্রতিষ্ঠানের কাছে মানবাধিকার সুরক্ষা আশা করা কঠিন।

বিভিন্ন মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে যখন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করে, তখন আশা করা হয়েছিল, মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন রোধে প্রতিষ্ঠানটি কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে। প্রথমে এর চেয়ারম্যান করা হয়েছিল একজন শিক্ষাবিদকে। তিনি অন্তত যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় ঘটনা ঘটত, সেখানে ছুটে যেতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে কমিশনের চেয়ারম্যান পদে যঁাদের বসানো হয়, তাঁরা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা। অনেকে একে ঠাট্টা করে ‘সাবেক আমলাদের ক্লাব’ বলেও অভিহিত করেন। বর্তমানে কমিশনের চেয়ারম্যান ও একমাত্র বৈতনিক কমিশনারও সাবেক আমলা। ফলে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তাঁরা তদন্তে আগ্রহী হন না। সেমিনারে একজন বক্তা যথার্থই বলেছেন, ‘কমিশন ঘটনা তদন্তে এতটাই সতর্ক থাকে যে দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা যায় না কিংবা তারা সেটি করতে চায় না।’ অর্থাৎ তারা মানবাধিকার রক্ষার চেয়ে চাকরি রক্ষায় অধিক ব্যস্ত থাকেন।

সেমিনারে সমালোচকদের অভিমত হলো, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আগে কিছু করতে না পারলেও কথা বলত। এখন কমিশন অধিকাংশ ক্ষেত্রে নীরব থাকে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো দেখেও না দেখার ভান করে। উদাহরণ হিসেবে দুটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন আসকের পরিচালক নীনা গোস্বামী। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায় আগুনে পুড়ে ৫১ জন মারা যান। এর আগে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে কয়েকজন শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা হয়। অথচ দুটি ঘটনাতেই মানবাধিকার কমিশন ছিল নিশ্চুপ।

এ কথা ঠিক, যেকোনো আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানবাধিকার রক্ষার প্রধান দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সরকারের কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত ব্যক্তি নিজেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ হয়ে দাঁড়ালে তার প্রতিকার কী। এসব ক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিশনের এগিয়ে আসার কথা। তারা প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেকোনো ঘটনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তদন্ত করে সরকারের কাছে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করতে পারে। প্রয়োজনে উচ্চ আদালতেও যেতে পারে কমিশন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আর কিছু না পারুক, অন্তত সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে পারে, ‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ’। কিংবা বলতে পারে, ভুল বা অন্যায় হয়েছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত ব্যক্তিরাই পথ হারিয়ে ফেলেছেন।

মানবাধিকার কমিশনকে কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করতে হলে প্রথমেই এর নিয়োগপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকতে হবে। রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারবে না। যাঁরা সেখানে চেয়ারম্যান-কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাবেন, তাঁদের মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার থাকতে হবে। মানবাধিকারের চেয়ে চাকরি রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিলে এই প্রতিষ্ঠান কখনোই কার্যকর হবে না। দেশের মানুষ এমন মানবাধিকার কমিশন চায় না, যা নখদন্তহীন বাঘ হবে, মানবাধিকার রক্ষায় কোনো ভূমিকাই রাখতে অক্ষম।