নারীর অদৃশ্য কাজ

সম্পাদকীয়

আমরা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার কথা বলি। সংবিধানেও বলা আছে, নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করা যাবে না। কিন্তু পরিবার থেকে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি তারা বৈষম্যের শিকার হয়, তাহলে সমতা আসবে কীভাবে?

শনিবার সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আয়োজিত ওয়েবিনারে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে নারীর অদৃশ্য বা মজুরিবিহীন কাজের যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা হতাশাব্যঞ্জক। তথ্য-উপাত্তে উঠে এসেছে, পুরুষের চেয়ে নারীরা তিন গুণ মজুরিবিহীন কাজ করেন। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী নারীরা যেখানে দৈনিক ৫ দশমিক ৯৩ ঘণ্টা মজুরিবিহীন গৃহস্থালির কাজ করেন, সেখানে পুরুষেরা করেন ১ দশমিক ৪৯ ঘণ্টা। অন্যদিকে ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সী নারীরা মজুরিবিহীন অদৃশ্য কাজ করেন গড়ে ৫ দশমিক ৮৭ ঘণ্টা আর পুরুষেরা করেন ১ দশমিক ৮৭ ঘণ্টা। প্রতি ঘণ্টায় মজুরিবিহীন কাজে সময় দেওয়ার কারণে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ১ দশমিক ৮ শতাংশ কমে যায় বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন।

এর প্রতিকার কী। প্রতিকার হলো নারী ও পুরুষ ঘরে বা বাইরে যে কাজ করেন, সব ক্ষেত্রে তাঁর মজুরি নিশ্চিত করা। নারী যেখানে যে কাজই করুন না কেন, তঁার মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। গৃহস্থালির কাজ কথা সন্তান পালন, রান্নাবান্না প্রভৃতিকে মূল্যহীন কাজ ভাবা যাবে না। বাস্তবে দেখা যায়, যেসব নারী নির্দিষ্ট সময়ে বাইরে কাজ করেন, ঘরেও পুরুষের অপেক্ষা তঁাদের বেশি কাজ করতে হয়। শিশুদের দিবাযত্নকেন্দ্র না থাকার কারণেও অনেক নারী ঘরে থাকতে বাধ্য হন। নারীর মজুরিভিত্তিক কাজের সময় বাড়াতে হলে পরিবারের দায়িত্ব তথা সন্তান লালন-পালন, রান্নাবান্না, বাজারসদাই করার কাজও ভাগ করে করতে হবে। অনেক পরিবারেই পুরুষ অভিভাবক সংসারে কিছু টাকা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। এমনকি তাঁরা সন্তান কোন বিদ্যালয়ে ও কোন শ্রেণিতে পড়ছে, তার খোঁজখবরও রাখেন না। ঘরের কাজ পুরুষেরাও ভাগ করে নিলে নারীর পক্ষে বাইরে বেশি কাজ করতে সুবিধা হয় এবং তাদের মজুরিবিহীন ‘গৃহিণীর’ তকমা নিতে হয় না।

বাংলাদেশে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এমনকি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেশিক্ষার্থীর চেয়ে মেয়েশিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু সে তুলনায় কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অনেক কম। এর ফলে নারী লেখাপড়া করে নিজেকে যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার পরও তা কাজে লাগাতে পারছেন না।

এ ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বাধাগুলো দূর করতে হবে। ঘরের বাইরে নারীর কাজ করা নিয়ে সমাজে যেসব অপপ্রচার আছে, তা বন্ধ করতে হবে। নারীর বাইরে কাজ করার ক্ষেত্রে কর্মস্থল ও গণপরিবহনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

ঘরে-বাইরে সব কাজের আর্থিক মূল্য নির্ধারণের পাশাপাশি যেসব পরিবারে নারীরা বাইরে কাজ করেন, তাঁদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। আমাদের জাতীয় আয়ে নারীর হিস্যা বাড়াতেই হবে।