গত বুধবার প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল ‘ট্যানারির বর্জ্য গোপনে ফেলা হয় নদীতে’। আইনানুযায়ী, ট্যানারির বর্জ্য পরিশোধন করার পর নদীতে ফেলার কথা। কিন্তু সাভারের চামড়াশিল্প নগরের কতিপয় কারখানামালিক রাতের অন্ধকারে পাইপ দিয়ে অপরিশোধিত বর্জ্য ধলেশ্বরী নদীতে ফেলে দিচ্ছেন বলে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
২০০৩ সালে হাজারীবাগ থেকে শিল্পকারখানাগুলো সাভারে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও কাজ শুরু করতেই ৯ বছর লেগে যায়। হাজারীবাগে শোধনাগার ছিল না। তাই চামড়াশিল্পের বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হতো। সাভারে স্থানান্তরিত শিল্পনগরে ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে শোধনাগার নির্মাণ করা হয়, যদিও এর মান নিয়ে কারখানামালিকেরা আপত্তি করেছেন।
২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল চামড়া কারখানাগুলো সাভারে স্থানান্তরের পর থেকে কারখানামালিক ও স্থানীয় জনগণের অভিযোগের অন্ত নেই। শিল্পনগরের জন্য যেসব কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার, সেগুলো নিশ্চিত করা হয়নি। অন্যদিকে কারখানামালিকদেরও আইন ভঙ্গ করার অসংখ্য নজির আছে, যার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হলো রাতের আঁধারে পাইপের মাধ্যমে অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলে দেওয়া। প্রথম আলোর প্রতিবেদক রাতে গিয়ে দেখেন, পাইপ দিয়ে অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু সকালে সেই পাইপের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এতে পরিবেশই কেবল ধ্বংস হচ্ছে না, নদীর মাছ ও শুশুকও মারা যাচ্ছে। চামড়ার বর্জ্য ফেলায় পানি এতটাই দূষিত যে মানুষ নদীতে নামতে ভয় পাচ্ছে।
বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করতে হাজারীবাগের চামড়াশিল্প হাজারীবাগ থেকে সরানো হয়েছিল। এখন সাভারের চামড়াশিল্পের কারণে ধলেশ্বরীকে ধ্বংস হতে দেওয়া যায় না। এই কাণ্ড তো সরাসরি নদী হত্যার শামিল। এর আগে বিসিক কারখানামালিকদের মোটা অঙ্কের জরিমানা করলেও তঁারা আপিল করে তা ঠেকিয়ে রেখেছেন। কাজে আসেনি পরিবেশসংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাময়িক কারখানা বন্ধ রাখার সুপারিশও। কথায় বলে, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। কতিপয় কারখানামালিক আইন লঙ্ঘন করেই চলেছেন। বিসিকের জরিমানা কিংবা সংসদীয় কমিটির সতর্কবাণী—কোনো কিছুই তাঁদের নিবৃত্ত করতে পারছে না। শোধনাগার কার্যকর নয়—এ অভিযোগে কারখানামালিকেরা অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলতে পারেন না। আইন মেনেই তঁাদের কারখানা পরিচালনা করতে হবে।
তবে এ কথাও সত্য যে সব কারখানামালিক এই অপকর্মে লিপ্ত নন। চামড়াশিল্প মালিক সমিতির উচিত সংশ্লিষ্ট মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কতিপয় কারখানামালিকের জন্য নদীদূষণ ও হত্যা, অন্যদিকে বিসিকও কারখানামালিকদের হাতে শিল্পনগর হস্তান্তর করে দায়িত্ব শেষ করতে পারে না। সেখানে অবকাঠামোগত সমস্যা থাকলে তা জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের দাবি, কারখানামালিকেরা পরিবেশের ছাড়পত্র নেননি। কারখানামালিকেরা বলছেন, বিসিক তাদের শর্ত পূরণ করেনি। তিন পক্ষের এই রশি-টানাটানিতে সেখানকার পরিবেশের ক্ষতি হবে, স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। যাঁরা কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলেছেন, তাঁদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হোক। চামড়াশিল্পের নামে নদী হত্যা কিংবা পরিবেশ ধ্বংসের এই সর্বনাশা উদ্যোগ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।