করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার যে আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, কোনো কোনো খাতে তার শতভাগ খরচ হয়েছে; আবার কোনো কোনো খাতে মাত্র ৬ শতাংশ খরচ হওয়া অস্বাভাবিকই বটে। কোভিড-১৯-এর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, যেগুলোর মোট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। সরকার চলতি বছরের জুলাই মাসে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার আরও পাঁচটি প্যাকেজ ঘোষণা করে। সব মিলিয়ে মোট প্যাকেজের সংখ্যা ২৮ এবং বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা।
প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, প্রথম দফায় ঘোষিত ২৩টির মধ্যে ৫টি প্যাকেজের বাস্তবায়নের হার খুবই শোচনীয়। এগুলো হলো যথাক্রমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, তৈরি পোশাক ও চামড়াশিল্পের দুস্থ শ্রমিক, রপ্তানিমুখী শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কৃষিজীবী ও করোনা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সরকারি কর্মচারীদের বিমা। মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১২ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। কিন্তু গত জুন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৮০৪ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এটি অবশ্যই হতাশাজনক। অর্থ খরচ না হলে বরাদ্দ দিয়ে কী লাভ?
অন্যদিকে সফল প্যাকেজগুলোর উপকারভোগীরা হচ্ছেন রপ্তানিমুখী শিল্পশ্রমিক, রপ্তানিমুখী শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মী, দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং গৃহহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এগুলোর মধ্যে পাঁচটির বাস্তবায়ন হার শতভাগ ছাড়িয়ে গেছে; অর্থাৎ বরাদ্দের চেয়ে বেশি খরচ হয়েছে। বাকি ১৩ প্যাকেজের বাস্তবায়ন হার আছে মাঝামাঝি অবস্থায়। ১৪ মাসে মোট অর্থের মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে ৭৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৯৬ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা।
যেসব প্রণোদনা প্যাকেজের বরাদ্দ শতভাগ বা এর কাছাকাছি খরচ হয়েছে, সেসব প্যাকেজের আওতাভুক্ত উদ্যোক্তা ও শ্রমিকেরা নিঃসন্দেহে উপকৃত হয়েছেন। দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে এ প্রণোদনা বিরাট অবদান রেখেছে। কিন্তু যেসব প্রণোদনা প্যাকেজের বরাদ্দ ৬ শতাংশ কিংবা তার চেয়েও কম খরচ হয়েছে, সেসব প্যাকেজের আওতাভুক্ত উদ্যোক্তা ও শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এসএমই খাতে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার কোটি টাকা, খরচ হয়েছে মাত্র ২৯ কোটি টাকা, শতকরা হিসাবে ২ শতাংশের কম। ফলে শ্রমঘন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা বঞ্চিত হয়েছেন। বঞ্চিত হয়েছেন এ খাতে নিয়োজিত লাখ লাখ শ্রমিক। ব্যাংকগুলো বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যতটা উৎসাহী, ছোট অঙ্কের ঋণ দিতে ততটা নিরুৎসাহী। সে ক্ষেত্রে সরকারকে বিশেষ তহবিল থেকে বিকাশ, নগদ বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও ঋণ বিতরণের কথা ভাবতে পারে।
পুরোনো অভাবী মানুষের সঙ্গে নতুন অভাবী মানুষ যুক্ত হয়েছে। এ কারণে সরকার ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণে যে ৭৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল, জুনের মধ্যে তার পুরোটা খরচ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এ খাতে আরও বরাদ্দ প্রয়োজন। কিন্তু ‘গৃহহীন মানুষের জন্য গৃহনির্মাণ’ প্যাকেজে ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা বরাদ্দের স্থলে জুনে ২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা খরচ হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তড়িঘড়ি করে অনেক স্থানে গৃহহীনদের জন্য তৈরি ঘর ধসে পড়েছে। প্রণোদনার নামে আর্থিক প্রণোদনা খরচই যথেষ্ট নয়, তার জবাবদিহিও নিশ্চিত করতে হবে।