২০ বছর পর আফগানিস্তানে আবার তালেবানের ক্ষমতা দখল বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাও, তালেবানশাসিত আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কী? চার দশকের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ আর হানাহানিতে বিপর্যস্ত আফগানিস্তানে কি শান্তি আসবে? তবে আফগানিস্তানের এই পট পরিবর্তনে ধারাবাহিকভাবে আবারও প্রমাণিত হলো, কোনো বিদেশি শক্তি যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, অন্য কোনো দেশের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু চাপিয়ে দিয়ে তাদের সফল হওয়ার সুযোগ নেই।
কাবুলে প্রায় বিনা রক্তপাতে তালেবানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর সেখানকার মানুষ চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে। দেশত্যাগের জন্য কাবুল বিমানবন্দরে হাজার হাজার লোক মরিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছে। দ্রুত সেখানে শাসনকাঠামো প্রতিষ্ঠিত না হলে শান্তিশৃঙ্খলার অবনতি ঘটার আশঙ্কা আছে। আফগানিস্তান থেকে যেসব খবর আসছে, তাতে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ সরকারের কাঠামো সম্পর্কে এখনো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহীন ‘সমন্বিত আফগান সরকার’–এর কথা বলেছেন। তালেবান নেতা আমির খান মুত্তাকি আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এবং একসময় দেশটির শান্তিপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত শীর্ষ কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর সঙ্গে কাবুলে আলোচনায় বসেছেন। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশিদের হটানো তালেবান নিজেদের কতটা বদলাতে পেরেছে? অতীতের তালেবান শাসনের অভিজ্ঞতা নিলে এই প্রশ্ন খুবই সংগত। তালেবানের সেই শাসন শুধু আফগানিস্তান নয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও সর্বনাশা প্রভাব ফেলেছিল।
২০ বছর আগের তালেবান সরকার আফগানিস্তানে মানবাধিকারের কোনো তোয়াক্কা করেনি, নারী শিক্ষা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল। সে সময়ে দেশটিতে ভিন্নমত ও ভিন্ন ধর্ম চরমভাবে আক্রান্ত হয়েছে। আফগানিস্তান হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ও জঙ্গিগোষ্ঠীর বিচরণ ক্ষেত্র। যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর আল–কায়েদার আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারী তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক অভিযান। সেই তালেবানের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত আলোচনায় বসেছে এবং আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। গত এক বছরে তালেবান চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে আলোচনা করেছে এবং বিভিন্ন কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তালেবান তাদের আগের অবস্থান বদলের কিছু অঙ্গীকার করেছে। দোহায় প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তালেবান মুখপাত্র তাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে যেসব কথা বলেছেন, তাতেও পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি আছে। সমানে তা কার্যকর হয় কিনা সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
চীন, পাকিস্তান ও ইরান তালেবানের নেতৃত্বে নতুন আফগান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে বলে জানিয়েছে। রাশিয়ার মনোভাবও ইতিবাচক। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং দেশটির জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কিছু আফগান শরণার্থীকে সাময়িক আশ্রয় দেওয়ার যে অনুরোধ জানিয়েছিল, তা বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই নাকচ করে দিয়েছে। আফগান পরিস্থিতি এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট আকার ধারণ করেনি, তাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই বাংলাদেশকে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আফগানিস্তানে তালেবান শাসন উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। আফগানফেরত ও তালেবান মতাদর্শে উদ্বুদ্ধরা কী করতে পারে, তার তিক্ত অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের রয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আগেই বাংলাদেশ থেকে কিছু তরুণের সেখানে যাওয়ার উদ্বেগজনক খবর প্রকাশিত হয়েছে। তালেবানের তরফ থেকে আফগানিস্তানের ভূখণ্ডে বাইরের কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও আমাদের তাই নিরুদ্বেগ থাকার কোনো কারণ নেই।
আফগানিস্তানে কী ধরনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, সেটি দেশটির জনগণই ঠিক করবে। কিন্তু সেই সুযোগে বাংলাদেশে কোনো জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী যেন মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে, সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।