মোটরসাইকেল কি সড়কে একটি মৃত্যুফাঁদ

সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে দৈনন্দিন জীবনের একটি অমীমাংসিত সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন অনেক মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন। বাংলাদেশের সড়কগুলোতে প্রতিদিন ঘটে চলা দুর্ঘটনার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। সড়ক শৃঙ্খলা না মেনে, অদূরদর্শিতায়, একটু তাড়াহুড়া করতে গিয়ে চলে আসে অপ্রত্যাশিত বিপদ। এমনকি মাত্র একটি মুহূর্তের ভুল সিদ্ধান্ত একজন মানুষের জীবন কেড়ে নিতে পারে বা একটি পরিবারের সুখের পরিবেশ বদলে দিতে পারে। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। ২০২৪ সালে প্রকাশিত রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ২০২৪ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১ হাজার ২০০ জন। শুধু তা–ই নয়, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা আড়াই গুণ বেড়েছে।

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ঘটে চালকদের অতিরিক্ত গতির কারণে। এ ধরনের দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০ শতাংশ চালক নিহত হন। আরেকটি অন্যতম কারণ সুরক্ষা–ব্যবস্থার প্রতি উদাসীনতা। বাংলাদেশে মোটরসাইকেলচালকদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ চালক হেলমেট ব্যবহার করেন না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে মাথায় আঘাতের ঝুঁকি ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে, হেলমেট ব্যবহার করলে মাথার আঘাতজনিত মৃত্যুর আশঙ্কা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে যায়। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে রাস্তা ও পরিবহনের অবস্থাও ব্যাপকভাবে দায়ী। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ঘটছে খারাপ সড়ক পরিস্থিতির কারণে। যেমন সড়কে ফাটল, পিচ্ছিলতা, অনুপযুক্ত সড়ক–নকশা ইত্যাদি।

এ ক্ষেত্রে সড়ক সংস্কারের অভাবে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। অবৈধ পার্কিং এবং ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাকে উৎসাহিত করে। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোটরসাইকেলচালকদের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করেন এবং অবৈধভাবে রাস্তা পারাপার হন। ফলে রাস্তায় সংঘর্ষের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায় এবং দুর্ঘটনা ঘটে। তা ছাড়া দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে আনতে ‘মোটরযানের গতিসীমা–সংক্রান্ত নির্দেশিকা, ২০২৪’ জারি করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সেই নির্দেশিকা অনুযায়ী সড়কভেদে মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। শহরে ও গ্রামে সর্বোচ্চ গতি ৩০ কিলোমিটার। যদি কেউ গতিসীমা লঙ্ঘন করেন, তাঁর বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইন অমান্যকারীকে ৩ মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হতে পারে। কিন্তু এ আইনের প্রয়োগ দেখা যায় না।

মোট দুর্ঘটনার প্রায় অর্ধেকই যখন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, তখন এর রাশ টেনে ধরা ছাড়া সড়কের মৃত্যুর মিছিল থামানোর কোনো উপায় নেই। মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সমাজের সব শ্রেণি–পেশার মানুষ, সড়ক ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারকারী, সবাইকে সংযুক্ত করে দেশব্যাপী নিরাপদ সড়কের জন্য ক্যাম্পেইন চালানো দরকার। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্পিড রাডার বসানোর পাশাপাশি নির্দিষ্ট সীমার তুলনায় অধিক গতিতে মোটরসাইকেল চালানোকে নিরুৎসাহিত করা জরুরি। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে বিআরটিএর কর্মকর্তাদের আরও দায়িত্বশীল ও সতর্ক থাকতে হবে, যেন অসদুপায় অবলম্বন করে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া না যায়। ট্রাফিক পুলিশকে আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে আরও কঠোর ও দায়িত্বশীল হতে হবে।

এ ক্ষেত্রে শ্রেণি ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে কঠোরভাবে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের পাশাপাশি যাত্রীদেরও সজাগ থাকা দরকার। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কেবল মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা ও ট্রাফিক সপ্তাহ পালন যথেষ্ট নয়। দুর্ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। যানবাহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বশীলতাও কাম্য। প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স ছাড়া কেউ যেন মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নামতে না পারেন, তা কঠোর নজরদারির মধ্যে আনতে হবে। বৈধ লাইসেন্স ছাড়া মোটরসাইকেল বিক্রি বন্ধ করতে হবে। সর্বোপরি মোটরসাইকেলের দ্বারা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং আইন পালনে জনসাধারণের সদিচ্ছা ও সচেতনতার বিকল্প নেই।

  • প্রজ্ঞা দাস
    শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
    ইডেন মহিলা কলেজ।