‘সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি’ নিয়ে প্রশ্ন, সন্দেহ ও বিতর্কের শেষ নেই। বিষয়টি নিয়ে একটি নিবন্ধ (সৃজনশীল প্রশ্ন: হাটে হাঁড়ি ভাঙল মাউশি) লিখেছেন (প্রথম আলো, ১৩.০৯.১৭) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আমিরুল আলম খান। সমালোচনার একপর্যায়ে লেখক সৃজনশীল শিক্ষা ও প্রশ্নপদ্ধতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ সৃজনশীলতা ‘বোঝেন না’, ‘জানেন না’ ও ‘শেখাতেও পারেননি’ বলে মন্তব্য করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে এ পদ্ধতির প্রবক্তা, ‘কোর ট্রেইনার’ এবং পদ্ধতিটি বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুরো প্রশাসনকে এভাবে ‘অজ্ঞ’ জ্ঞান করা কি সমীচীন? লেখায় তিনি ‘সৃজনশীলের রথ থামছে না’ বলে উল্লেখ করেও নিবন্ধটির অনলাইন মন্তব্যে লিখেছেন, ‘আমি সৃজনশীল পদ্ধতিকে সমালোচনা করিনি। আমি তার প্রশংসা করি।’ প্রশংসা করলে সৃজনশীলের রথ থামার পরিবর্তে কেমন করে তা ভালোভাবে চলবে সে বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।
আমেরিকান শিক্ষাবিদ বি এস ব্লুম তাঁর দলবল নিয়ে প্রায় চার বছর (১৯৫৩-৫৬) গবেষণা করে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্যগুলোকে তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে শ্রেণিবিন্যাস করেন। চিন্তন, ভাবাবেগ ও মনোপেশিজ ক্ষেত্রের প্রতিটিতেই কয়েকটি করে স্তর রয়েছে। প্রথম ক্ষেত্রটিতে রয়েছে ছয়টি দক্ষতা স্তর। যথা জানা, বোঝা/অনুধাবন, প্রয়োগ, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ/সৃষ্টি ও মূল্যায়ন।
‘সৃজনশীল’ প্রশ্নের দর্শন হচ্ছে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ওই সব স্তরে পৌঁছানো ও মূল্যায়ন করা। শেষ তিনটি স্তরকে একসঙ্গে বলা হয় উচ্চতর দক্ষতা। উচ্চতর তিন দক্ষতার মধ্যে শুধু বিশ্লেষণ/সৃষ্টি স্তরটি প্রকৃত অর্থে সৃজনশীল। বাংলাদেশে ‘সৃজনশীল’ প্রশ্নের ১০ নম্বরের কাঠামোতে জানা স্তরের জন্য ১, অনুধাবনের জন্য ২, প্রয়োগের জন্য ৩ এবং উচ্চতর দক্ষতা তিনটির যেকোনোটির জন্য ৪ নম্বর ধার্য করে চার স্তরের ‘কাঠামোবদ্ধ’ প্রশ্ন তৈরি করা হয়েছে। জানার চেয়ে উঁচু স্তরের প্রতিটি ‘জানা’ দিয়ে শুরু হয়, তাই প্রশ্নের প্রতিটি স্তরেই জানার জন্য ১ নম্বর ধার্য থাকে। আবার অনুধাবনের উঁচু উভয় স্তরের দ্বিতীয় ধাপে বোঝার প্রয়োজন থাকে বলে অনুধাবন দক্ষতার জন্য উভয়টিতে ১ নম্বর করে ধার্য থাকে। সেরূপ উচ্চতর দক্ষতার ক্ষেত্রেও তৃতীয় ধাপে প্রয়োগ দক্ষতার প্রয়োজন আছে বলে এ স্তরের জন্যও ১ নম্বর ধার্য থাকে। অর্থাৎ একটি ‘সৃজনশীল’ প্রশ্নের মোট ১০ নম্বরের মধ্যে জানা স্তরের ভাগে পড়ে ৪, অনুধাবনের ৩, প্রয়োগের ২ ও উচ্চতর দক্ষতার ভাগ মাত্র ১। যেহেতু উচ্চতর তিন দক্ষতার মোট ভাগ ১০-এর মধ্যে মাত্র ১ বা ১০ শতাংশ, সেহেতু শুধু ‘সৃষ্টি’ (প্রকৃত সৃজনশীল) স্তরের ভাগে পড়ে গড়ে ৩০-এর মধ্যে ১। অর্থাৎ একটি ‘সৃজনশীল’ প্রশ্নের প্রকৃত সৃজনশীল অংশ মাত্র ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ হতে পারে।
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি যতটা ভালো বলে অনেকে দাবি করেন, ততটা ভালো না হলেও এর প্রয়োজন অবশ্যই আছে। কারণ, এতকাল আমরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা মূল্যায়নে চিন্তন ক্ষেত্রের প্রধানত প্রথম দুটি স্তরে (জ্ঞান ও অনুধাবন) বিচরণ করেছি; শুধু গণিতে প্রয়োগ স্তর ও বিজ্ঞানে বিশ্লেষণ স্তরে পৌঁছাতাম। ‘সৃজনশীল’ নামের সুগারকোটিংয়ের আওতায় শক্ত কাঠামোর বাঁধনে এখন অতি অল্প মাত্রায় হলেও সব কটি দক্ষতা স্তরের পরীক্ষা হচ্ছে।
এখন দরকার এ প্রশ্নপদ্ধতিকে আরও সমৃদ্ধ করে বিষয়ভিত্তিক উচ্চতর দক্ষতার হার বাড়ানো। কারণ, সব বিষয়ে জ্ঞান ও অনুধাবন স্তর কমন থাকলেও বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর দক্ষতাগুলোর ভিন্নতর হার বিদ্যমান। কাঠামো ভেঙে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন স্তরের দক্ষতার জন্য ভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করা দরকার। যেমন স্কুল পর্যায়ের গণিতে প্রয়োগের ওপর বেশি, বিশ্লেষণের ওপর কম প্রশ্ন হতে পারে; বিজ্ঞানে বিশ্লেষণের ওপর বেশি, সৃষ্টির ওপর কম; সমাজবিজ্ঞানে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নে বেশি; আর ভাষা ও সাহিত্যে মূল্যায়ন ও সৃষ্টির ওপর বেশি প্রশ্ন হতে পারে।
প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর উদ্দেশ্যে প্রশ্নকে অনন্য (Unique) বানানোর জন্য যে উদ্দীপক পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল, তা ভালো কাজ করছে না। নকলনবিশেরা গাইড বানিয়ে ফেলেছে। বাস্তবে গণিতে প্রয়োগ স্তরটি যেরূপ স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়, অন্যান্য বিষয়ে, বিশেষত সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞানে সেরূপ পাওয়া যায় না। সনেটের মতো কাঠামোর শক্ত বাঁধন রক্ষা করতে গিয়ে প্রধানত প্রয়োগ স্তরের প্রশ্নের জন্য উদ্দীপকে বিভিন্ন স্থান, বিষয় ও ব্যক্তির মধ্যে তুলনা করা হয়। এসব তুলনা অনেক ক্ষেত্রে অসম হওয়ায় ব্যক্তির প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও প্রশ্নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের অপমানিত ও নিগৃহীত হতে হচ্ছে।
প্রায় ১৩ বছরের চেষ্টার পরও আমরা দেখছি সৃজনশীল প্রশ্ন বোঝা ও তৈরি করা কঠিনই রয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমন হয়? কেন এখনো মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৫২ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন প্রস্তুত করতে পারছেন না? এর প্রধান কারণগুলো হচ্ছে ১. প্রশিক্ষণের অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা, ২. প্রশিক্ষণ কর্মশালায় দক্ষতা স্তর বোঝার চেয়ে উদ্দীপক তৈরিতে গলদঘর্ম হওয়া, ৩. বাজারে প্রস্তুত গাইড থেকে প্রশ্ন পাওয়ার সুযোগ, ৪. পরিণামে শিক্ষকদের শেখায় কম গুরুত্ব দেওয়া।
আমাদের কিছু জাতীয় প্রবণতা এসব কারণের পেছনের কারণ হিসেবে বিদ্যমান। জাতি হিসেবে আমরা কাজ করি যতটা না ‘কাজ হওয়ার জন্য’, তার চেয়ে বেশি ‘দেখানোর জন্য’। ইউনিসেফের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুসারে জাতীয় আয়ের ৪-৬ শতাংশ (সর্বনিম্ন ৪ শতাংশ) শিক্ষায় বিনিয়োগ করার কথা। আমাদের শিক্ষা খাতে ব্যয় এখনো জিডিপির ২ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে।
শুধু কর্মশালায় কয়েক দিনের প্রশিক্ষণে সব শিক্ষককে প্রশিক্ষিত করা প্রায় অসম্ভব। প্রশিক্ষণের জন্য গণমাধ্যম ব্যবহার করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের অধ্যাপক ড. শাহজাহান মিয়া একসময় টেলিভিশনে বেশ সাফল্যের সঙ্গে বিজ্ঞান পড়িয়েছেন। এনসিটিবি, নায়েম ও পরীক্ষা বোর্ডগুলোতে কর্মরত অন্তত ১০০ জন ‘সৃজনশীল’ বোদ্ধা রয়েছেন। আইইআরের শিক্ষক ও উল্লিখিত ব্যক্তিরা বিষয়টি নিয়ে লিখতে পারেন এবং টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমে আলোচনা করতে পারেন।
লেখার কথা বলছি। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের লেখায় অনেক বাধা আছে। তা ছাড়া ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও আমরা আসলে একটি ‘স্তুতি-বন্দনা’ বনাম ‘হিংসা-বিদ্বেষ’-এর কৃষ্টি গড়ে তুলেছি। এ কৃষ্টি থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নিলেই শুধু বহু কষ্টে অর্জিত এ স্বাধীন দেশের জনগণ মুক্তভাবে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে ও শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারবে।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা: শিক্ষা গবেষক এবং বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার সদস্য।
[email protected]