'এখানে ফ্যাশন করে চুল কাটা হয় না'

‘তুমহে আপনা বানানে কি কসম খাইহে...খাইহে’—এই গান শুনলে মহেশ ভাটের ‘সড়ক’ ছবির কথা মনে পড়ে। সঞ্জয় দত্তের কথা মনে পড়ে। সঞ্জয়ের ঘাড় ডিঙিয়ে কাঁধে এসে পড়া চুলের কথা মনে পড়ে। সঞ্জুর সামনের চুল ব্যাকব্রাশ করা ছিল, কানের ওপরের অংশের চুল ছোট ছিল। পেছনের চুল ছিল বড়।

সে বছর ‘সড়ক’ ছবির তোড়ে ভেসে ছেলেরা গণহারে সঞ্জুছাঁটে চলে গেল। মেথর থেকে কলেজপড়ুয়া—সবাই। বিষয়টা আমাদের এলাকার আজমাইন দারোগার মোটেও ভালো ঠেকল না। রাস্তাঘাটে বখাটে-বেয়াদবদের তিনি কড়া সাজা দিতেন। গার্লস স্কুলের সামনে কাউকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলে ওই স্কুলের গেটে নিয়ে তাকে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। চড়-থাপ্পড় তাঁর কাছে জলভাত ছিল।

তো আজমাইন দারোগা সঞ্জুছাঁটের সব পোলাপান ধরে ধরে সেলুনে ঢোকাতে লাগলেন। সেলুন থেকে বের হওয়ার পর তাদের চেহারায় ‘ভালো ছাত্র’ ধরনের ‘লুক’ এসে গেল। চুলে নারকেলের তেল দেওয়ার পর তাতে চিরুনি মারতেই মনে হতে লাগল, এই ছেলের মতো সভ্যভব্য গুডবয় আর নাই।

ময়মুরুব্বিরা বিরাট খুশি। তাঁরা আজমাইন দারোগাকে রীতিমতো সংবর্ধনা দিলেন। তবে খারাপ খবর হলো, সঞ্জুভক্তদের চুলের দৈর্ঘ্য কমলেও এলাকায় ইভ টিজিং থেকে পাতি মাস্তানি—কোনোটাই আগের চেয়ে কমল না। তখন আমরা এই অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলাম, ‘সব বখাটে স্টাইলিশ হয় না, সব স্টাইলিশ বখাটে হয় না’।

এত দিন পর সেই গল্প মনে করিয়ে দিলেন টাঙ্গাইলের সখীপুর ও ভূঞাপুর, ঢাকার সাভার এবং ঝালকাঠির পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নরসুন্দরদের প্রতিনিধিরা।

খবরে দেখলাম, ৭ মার্চ টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাশিদুল ইসলাম একটি নোটিশ জারি করেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল, ‘চুল-দাঁড়ি-গোঁফে ফ্যাশন করার ওপর সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে কেউ ফ্যাশন করে চুল-দাঁড়ি কাটলে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে।’ নোটিশের নিচে স্বাক্ষর ছিল স্থানীয় নরসুন্দর সমিতির সভাপতি শেখর শীল, সাধারণ সম্পাদক অরুণ শীল ও ওসি রাশিদুল ইসলামের (চিন্তা করে দেখেন, সরকারি নোটিশে নরসুন্দররাও আজকাল সই করছেন)। পরে অবশ্য ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ঝোটন চন্দ চুল কাটার নিয়ম বেঁধে দেওয়াকে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হিসেবে আমলে নিয়ে পুলিশের ইস্যু করা নোটিশটি খারিজ করে দেন।

এরপর দেখা গেল, ঝালকাঠিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহমুদ হাসান স্থানীয় নরসুন্দর সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাঁদের স্থানীয় ছেলেদের চুল ‘মার্জিতভাবে’ কাটার ‘অনুরোধ’ করেন। মাহমুদ হাসান বলেছেন, ছাত্রীদের কাছ থেকে তিনি জেনেছেন, যারা ইভ টিজিং করে, তাদের বেশভূষা ও চুলের স্টাইল দেখলেই তারা ভয় পায়। তাঁর অনুরোধের পর নরসুন্দররা ‘অমার্জিত’ স্টাইলে ছেলেদের চুল কাটবেন না বলে তাঁকে কথা দিয়েছেন।

এদিকে সাভারের জনপ্রতিনিধিরাও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চুল কেমন করে কাটাতে হবে, তা নিয়ে বেশ তৎপর হয়েছেন। তাঁরা বলছেন, সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে তাঁরা এই ‘ভালো’ কাজ করছেন।

সাভার পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সাভার পৌর প্যানেল মেয়র হাজী মো. সেলিম মিয়া গত মঙ্গলবার স্থানীয় নরসুন্দর সমিতির সঙ্গে বৈঠক করে বলে দেন, ‘বখাটে স্টাইলে’ চুল কাটা যাবে না। সেলুন কর্তৃপক্ষ বা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই অনুরোধ না মানলে তাদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তি দেওয়া হবে। তিনি নিজেই এই নিয়ম জারি করলেন, নাকি অভিভাবক বা শিক্ষকদের অনুরোধে উদ্যোগী হলেন? এ প্রশ্নের জবাবে সেলিম মিয়া বলেছেন, তিনি নিজে থেকেই ‘সমাজের উন্নয়নে’ এই কাজ হাতে নেন। তাঁর দেখাদেখি অন্য ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধিরাও এই কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অবশ্য তাঁর আগেই তেঁতুলঝরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ফখরুল আলম চুল কাটায় শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগ নেন।

তার মানে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা তরুণ সম্প্রদায়ের কেশসংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি মহান সামাজিক আন্দোলনে নেমেছেন। তবে এই ‘আন্দোলন’ কতটুকু সমর্থনযোগ্য, তা তর্কসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হিপোক্রেসি বলুন আর যা-ই বলুন, এখন ডেমোক্রেসির যুগ। ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের যুগ। এই যুগে শিশুরা পর্যন্ত শিশু অধিকার আইন পড়ে বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে, আইনমতো তাদের বাপ-মা তাদের সঙ্গে আচার-ব্যবহার করছে কি না। তারপর আবার তাদের হাতে হাতে স্মার্টফোন। ফোনে ফোনে ফেসবুক। ফলে, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সাম্প্রতিক এই কেশসংস্কার মুভমেন্ট নিয়ে তাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। তারা প্রশ্ন তুলছে, কে কীভাবে চুল কাটবে, সেটা জনপ্রতিনিধি বা পুলিশ ঠিক করে দেওয়ার কে?

২.
চুল কাটার গল্প উঠলে বয়স্করা সহজেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। মনে পড়ে, বাল্যাবস্থায় হাঁটে-বাজারে কাঠের পিঁড়িতে বা ইটের ওপর বসে চুল কাটতে হতো। ইট-সম্বল এই নাপিতালয়কে বলা হতো ‘ইটালিয়ান সেলুন’। একটু শহরমতো এলাকায় আগেই সেলুন তৈরি হয়েছে। ‘অভিজাত’ লোকেরা সেখানে চুল কাটত। কী জানি কোন কারণে প্রায় সব সেলুনেই অর্ধেক মানবী অর্ধেক ঘোড়ার একটি ছবি ঝোলানো থাকত। কোনো কোনো সেলুনে এই ছবির নিচে কাগজে সাঁটা বাণী: ‘বগল কামাইয়া দিতে বলিবেন না’। ‘ইটালিয়ান সেলুনে’ চুল কাটার সঙ্গে ওটা ফাও ছিল। অভিজাত সেলুনে ওসব চলবে কেন?

অন্য সব এলাকার মতো আমাদের এলাকায়ও একটা ‘অভিজাত সেলুন’ ছিল। সেখানে রতন শীল ওরফে রতন কাকু ছেলেপেলের কেশ সংস্কার করতেন। রতন কাকু ছিলেন একাধারে জ্যান্ত বিবিসি ও গুগল। এলাকার কার মেয়ে কার ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে, থানকুনিপাতায় আমাশয় ছাড়াও আরও কী কী রোগ সারে—সব রতন কাকু জানতেন। সব তিনি কুট কুট করে বলতেন আর টুক টুক করে চুল কাটতেন। সঞ্জুছাঁটটা তাঁর হাতে খুলত ভালো। সব ছেলেপেলে তাঁর কাছে এই স্টাইলের জন্য যেত। আজমাইন দারোগার রাগারাগিও তিনি আমলে নিতেন না। কেউ এসে বললেই কাজ করে দিতেন।

হঠাৎ রতন কাকুর সেলুন বন্ধ। শোনা গেল, তিনি যাদের সঞ্জুছাঁটে চুল কেটে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ফুলটাইম বেকারের সঙ্গে তাঁর মেয়ে ভেগেছে। মাস খানেক পর রতন কাকুর দোকান খুললেন। যোগ হলো নতুন নোটিশ: ‘এখানে ফ্যাশন করে চুল কাটা হয় না’।

সারফুদ্দিন আহমেদ লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]