দেশের রাজনীতির গতি পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক ৭ নভেম্বর। ৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহকে মূলত স্বাধীনতাযুদ্ধের দুই অমিত সাহসী সেনানী জিয়াউর রহমান ও আবু তাহেরের দ্বন্দ্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখন যা বিএনপি ও জাসদের দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে। অথচ ঘটনার শুরুর দিকে খালেদ মোশাররফ ছিলেন মূল নায়ক।
মাঝখানে গণবাহিনী দিয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা কর্নেল তাহের ঘুঁটি নাড়তে শুরু করেছিলেন। শেষাংশে জিয়াউর রহমান সৈনিকদের কাঁধে চড়ে পাশার দান উল্টে দেন। তিনি নায়কের চরিত্রে হিসেবে মঞ্চে আবির্ভূত হন। অথচ শুরুতে তিনি গৃহবন্দী হয়েছিলেন। সৈনিকেরা তাঁকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে উদ্ধার করে কাঁধে চাপিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর দিকে এগিয়ে দেন। এর সঙ্গে জনগণেরও সমর্থন জুটে যায় জিয়ার ভাগ্যে। তাহেরের পক্ষে সেনাবাহিনী বা জনসমর্থন কোনোটাই ছিল না। এখান থেকেই মূলত জিয়া ও তাহেরের বিচ্ছেদ বা বিভাজনের শুরু।
সাধারণভাবে মনে হতে পারে, ৭ নভেম্বর ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলি বুঝি কেবলই জিয়া ও তাহেরের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের লড়াই। জাসদ অভিযোগ করে, জিয়াউর রহমান কথা রাখেননি। বরং নির্মমভাবে জাসদকে দমন করেছেন। কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ক্ষমতাকে আরও পোক্ত করেছেন। তবে এর বিপরীত মত হচ্ছে, কর্নেল তাহের জিয়াকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। জাসদকে ঘিরে কর্নেল তাহেরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিবরণ আগে থেকেই পাওয়া যায়।
কিন্তু কর্নেল তাহের বা জাসদ এককভাবে ক্ষমতা দখলে সক্ষম ছিল কি না, জাসদের প্রতি জনসমর্থন ছিল কি না—এসব বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে বেতারে ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার কারণে জিয়ার জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতার ওপর ভর করে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেছিল জাসদ ও কর্নেল তাহের।
এ রকম যুক্তি, পাল্টা যুক্তি, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, হত্যাকাণ্ড ও নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়েই জিয়া ক্ষমতায় চলে আসেন। বিএনপি বা জিয়ার অনুসারীরা মনে করেন, সিপাহি জনতার সম্মিলিত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জিয়া ক্ষমতার মঞ্চে উপবিষ্ট হন।
ওই সময় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও বিশৃঙ্খলার জন্য জনসাধারণ ক্ষুব্ধ ছিলেন। সদ্য স্বাধীন দেশের নাগরিকদের মধ্যে অতৃপ্তি ছিল। বেকারত্ব, বাজারে খাদ্যপণ্যের সংকট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, নানা ধরনের গুজব, দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্যের কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আস্থা হ্রাস পেতে থাকে। যে কারণে ৭ নভেম্বরের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী সরাসরি দীর্ঘ মেয়াদে রাজনীতি ও শাসনকাজে জড়িয়ে পড়ে। এতে করে আমাদের গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ওই সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই সেনাবাহিনী শাসনক্ষমতা দখল করেছিল। আরব, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় চলে আসেন। জিয়াউর রহমানও ৭ নভেম্বরের ঘটনা পরিক্রমায় ক্ষমতায় চলে আসেন। তবে তিনি ওই সময়ের অন্য সব সামরিক শাসকের থেকে ভিন্ন ছিলেন। একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করেননি। বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর একদলীয় শাসন পন্থা তিনি অনুসরণ করেননি।
সেই সময়ের সামরিক শাসিত দেশগুলোর তুলনায় জিয়ার শাসন পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। নতুন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে হাজির হন জিয়া। রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে তিনি অর্থনীতি পুনর্গঠনে মনোযোগ দেন। জিয়াউর রহমানের রাজনীতিকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করা যায়। জাতিবাদী ও নাগরিক জাতীয়তাবাদের ধারণা থেকে ভিন্ন নতুন এক জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিকাশ ঘটে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। হতে পারে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ জিয়াউর রহমানের একক চিন্তার ফসল না।
ওই সময় যাঁরা বিএনপি সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত ছিলেন ও পরবর্তী সময় বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছেন, তাঁদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই নতুন এই জাতীয়তাবাদী দর্শনের বিস্তার ঘটে। এর আগে অবশ্য বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের উল্লেখ মাওলানা ভাসানী ও আবুল মনসুর আহমদের বক্তৃতা ও লেখায় পাওয়া যায়। তবে ওই সব লেখা বা বক্তব্যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না।
মূলত ৭ নভেম্বরের পর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান দেশে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রয়োগ করেন। জাতীয়তাবাদ সব সময়ই বিতর্কিত ও বিপজ্জনক এক ধারণা। প্রবল জাতীয়তাবাদ উগ্রবাদে মোড় নেয়। গত শতকের শুরুর দিকে জার্মানি ও ইতালিতে জাতিবাদী জাতীয়তাবাদের ভয়াবহতা লক্ষ করা যায়।
এর আগেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই জাতিবাদী জাতীয়তাবাদের আবেদন ফিকে হতে শুরু করেছিল। বা আরও আগে ফরাসি বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের পর পরই জাতিবাদী জাতীয়তাবাদ নিয়ে জনমনে সন্দেহ শুরু হতে থাকে। ১৬৪৮ সালে ওয়েস্টফেলিয়ার চুক্তির পর জাতির পরিচয়ের ভিত্তিতে জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াকে আলোকিত ইউরোপ গ্রহণ করলেও সমস্যার সমাধান হয়নি।
ফলে দেখা যায়, জাতিবাদী জাতীয়তাবাদ ধর্মের নামে মানুষ বা প্রতিপক্ষকে হত্যা করলেও রাষ্ট্রের নামে হত্যা তথা যুদ্ধকে অনুমোদন দেয় জাতীয় স্বার্থ বা নিরাপত্তার নিরিখে। একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে খ্রিষ্টীয় নৈতিকতাকে আইন হিসেবে প্রয়োগ করতে শুরু করে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নাগরিকদের মধ্যে ‘আমরা ও তাহারা’ বিভাজন সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করতে শুরু করে।
ফলে দেখা যাচ্ছে রাজতান্ত্রিক ইউরোপ যে ধারণা বা দার্শনিক জায়গা থেকে গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে ব্রত হয়েছিল, তা অনেকটাই কার্যকর হয়নি। বরং বিশ শতকে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা জাতিবাদী জাতীয়তাবাদের ভয়ংকর দিকগুলো সামনে নিয়ে আসে।
জাতিবাদী জাতীয়তাবাদের বিকল্প হিসেবে নাগরিকের পরিচয় ভিত্তিতে নাগরিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে। কিন্তু উপনিবেশত্তোর যুগে নাগরিক জাতীয়তাবাদও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নাগরিক ও অ-নাগরিকেরা বিভাজন বজায় রেখেছিল। মূলত গত শতকের ষাটের দশক থেকেই জাতিবাদী ও নাগরিক জাতীয়তাবাদী ধারণার বাইরে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ হিসেবে ভিন্ন এক জাতীয়তাবাদী ভাবনার উন্মেষ ঘটতে থাকে।
এই জাতীয়তাবাদ কোনো জাতি বা নাগরিকত্বের ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয় গঠন করে না। বরং রাষ্ট্রের ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয় বা জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদী ধারণা অপেক্ষাকৃত উদার, বহুপক্ষীয় এবং সমাজে জাতি, বর্ণ ও ধর্মীয় পরিচয়গত বিভাজন অনুমোদন করে না।
৭ নভেম্বরের দার্শনিক উৎপাদন হচ্ছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। জনমানসে সম্ভবত এর উন্মেষ আগেই ঘটেছিল। ৭ নভেম্বর এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে কেবল। শ্রেণি বা চরিত্রগত দিক থেকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ প্রয়োগে পুরোপুরি সফল হলেও সমালোচনার ঊর্ধ্বে না। তিনি রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদের অন্য স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে আপস করেছিলেন। কিন্তু বর্ণ ও জাতিগত দিক থেকে বহুপক্ষীয়, অংশগ্রহণমূলক জাতীয়তাবাদ হিসেবে সফলভাবে এর প্রয়োগ করেছিলেন। এ কারণেই সমসাময়িক সামরিক শাসকদের থেকে জিয়াউর রহমান ব্যতিক্রম।
জিয়াউর রহমানের শাসনকাল নিয়ে প্রতিনিয়তই নিন্দামন্দ করা হয়। কিন্তু জিয়াউর রহমান নতুন নতুন ধারণা ও পরিকল্পনার প্রয়োগ করেছিলেন রাজনীতিতে। এসব কারণে ৭ নভেম্বর বা জিয়াউর রহমানকে ইতিহাসের পাতা থেকে বাইরে ঠেলে দেওয়া অসম্ভব।
মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: নাগরিক ও জাতিবাদী জাতীয়তাবাদের সংকট গ্রন্থের রচয়িতা