বিপ্লবের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তিউনিসিয়ায় আবার বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। এই বিক্ষোভ রাজধানী তুনিসের গণ্ডি পেরিয়ে প্রায় অন্য সব বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। ক্রমে অস্থিরতা বাড়ছে। হাজারেরও বেশি বিক্ষোভকারী গ্রেপ্তার হয়েছে। করোনা মহামারির ভয়কে উপেক্ষা করে মানুষের এই বিক্ষোভ তিউনিসিয়ায় প্রচলিত রাজনীতির বিপক্ষে এক স্পষ্ট প্রতিবাদ। গণমানুষ নতুনত্ব চায়, পরিবর্তন চায়। আঞ্চলিক রাজনীতি এবং ধর্ম আর সেক্যুলারিজমের তর্কে পিষ্ট না হয়ে দারিদ্র্য ঘোচাতে চায়। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোও ক্রমাগত রক্ষণশীল গণমানুষের এই আরজিকে উপেক্ষা করে আসছে। তিউনিসিয়ায় চলমান এই বিক্ষোভ ঘুরিয়ে দিতে পারে আঞ্চলিক রাজনীতির স্রোত।
করোনা মহামারিতে ধনপতিদের সম্পদ পাহাড়সম হয়েছে আর নিঃস্ব হতে চলেছে স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশগুলো। বিশ্ব অর্থনীতির আকস্মিক এই দুর্ভাগ্য থেকে তিউনিসিয়াও মুক্ত থাকেনি। তিউনিসিয়ায় মোট জিডিপির প্রায় ২০ শতাংশের জোগান দেয় পর্যটনশিল্প। কিন্তু করোনা মহামারির দরুন অন্যান্য বছরের তুলনায় পর্যটন আয় নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। তিউনিসিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে পর্যটন খাতে আয় ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যার দরুন বেকারত্ব বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। ১১ মিলিয়ন মানুষের দেশের প্রায় ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ কাজ করেন পর্যটনশিল্পে। এই অর্থনৈতিক দুর্দশার সঙ্গে যোগ হয়েছে নিত্যনতুন রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিক্ষোভ, সেনা অভ্যুত্থানের এবং সন্ত্রাসী হামলার গুজব তিউনিসিয়ায় মানুষের জীবনকে অস্থির করে তুলেছে। অথচ ১০ বছর ধরে তিউনিসিয়ায় গল্প এ রকম মলিন ছিল না কখনোই।
তথাকথিত ‘আরব বসন্তের’ সূতিকাগার ছিল তিউনিসিয়ায়। ‘বসন্ত’পরবর্তী সময়ে রক্ষণশীল-সেক্যুলারদের মধ্যকার আলোচনা এবং বোঝাবুঝির দরুন সিরিয়া, লিবিয়া ও মিসর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আখ্যানের অংশীদার ছিল তিউনিসিয়া। কিন্তু এই ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অচেনা এক আইনের প্রফেসর কাইস সাইয়িদ ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচন জিতে নিলে রক্ষণশীল আন নাহদা আর নানানভাবে বিভক্ত হওয়া সেক্যুলার গোষ্ঠী অস্তিত্বের সংকটে পড়ে। রাজনীতিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখতে প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলো চলমান সহাবস্থান ত্যাগ করে নিজেদের পাল্লা ভারী করার স্বার্থে আদর্শিক রাজনীতির পেছনে ছুটতে থাকে। ফলাফলস্বরূপ অস্থিরতা শুরু হয়েছিল অর্থনীতিসহ রাষ্ট্রের প্রায় সব বিভাগে। তবে এককভাবে তিউনিসিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোকে এই সমস্যার জন্য দায়ী করার সুযোগ নেই। আঞ্চলিক রাজনীতির মারপ্যাঁচও অনেকাংশে তিউনিসিয়ার বর্তমান এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
‘বসন্ত’পরবর্তী সময় থেকেই ইসলামি দলগুলো এবং সেক্যুলারদের মধ্যকার ঐক্যকে মেনে নিতে পারেনি সৌদি-আমিরাত-ইসরায়েল বলয়। সিরিয়া, লিবিয়ায় যুদ্ধের মাধ্যমে এবং মিসরে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা গেলও তিউনিসিয়ায় তা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমিরাত-সৌদি-ইসরায়েল বলয় থেমে থাকেনি। ক্রমাগত তিউনিসিয়ায় অস্থিরতা সৃষ্টি করার পাঁয়তারা করেছে। অর্থনৈতিক বিভাগে কিছুটা সফলও হয়েছে। সুদান ধাঁচের অভ্যুত্থানের ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছে বেশ কয়েকবার। আদতে সৌদি-আমিরাত-ফ্রান্স বলয় ঘানুশিকে নিশানা করে তাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনা করেছিল। ঘানুশি শুধুই তিউনিসিয়া নয়, বরং আঞ্চলিক এবং দুনিয়ায় প্রায় সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের পতনের পর।
তবে সাম্প্রতিক এই বিক্ষোভের কারণ অর্থনৈতিক হিসেবে বলা হলেও আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশ থেকে এই বিক্ষোভকে দূরে রাখা সম্ভব নয়। আঞ্চলিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি বিষয়ের ভবিষ্যৎ নির্ধারণকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে এই বিক্ষোভ।
প্রথমত, আগাম নির্বাচনের পথ প্রস্তুত করা। বর্ষপঞ্জির হিসাবে তিউনিসিয়ায় আগামী সংসদ এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বছর ২০২৪। অনেকটা তুরস্কের একেপির মতোই আন নাহদা প্রত্যক্ষভাবে ‘ধর্মভিত্তিক’ রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে ‘সেক্যুলারিজম’কে নিজেদের কর্মপন্থা হিসেবে ঠিক করেছে। এই পরিবর্তন আন নাহদার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করেছে। লিবারেল, সেক্যুলারদের একটি অংশকে এবং ফরাসি উপনিবেশবাদবিরোধীদের একই ছাতার নিচে সমাগত করার চেষ্টায় অনেকটা সফল আন নাহদা। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে ভোটের রাজনীতিতে এবং উত্তর আফ্রিকার আঞ্চলিক রাজনীতিতে আন নাহদার অবস্থান শক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশ জোরালো। আন নাহদার শক্ত অবস্থান কোনোভাবেই সৌদি-আমিরাত-ফরাসি বলয়ের জন্য সুখকর নয়।
দ্বিতীয়ত, আগামীর লিবিয়া থেকে তুরস্ক-কাতার বলয়কে দূরে রাখা। প্রায় আট মাস ধরে লিবিয়ায় উভয় পক্ষ শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধকে বিদায় বলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যুদ্ধবিহীন মীমাংসায় হাফতারের আগ্রহ নেই এবং ভবিষ্যৎও নেই। তাই লিবিয়ায় যুদ্ধকে বাঁচিয়ে রাখতে হাফতার সবকিছু করে যাচ্ছে। আর হাফতারকে উসকে দিচ্ছে আমিরাত, ফ্রান্স আর মিসর। লিবিয়া প্রশ্নে প্রতিবেশী আলজেরিয়া তার নিরপেক্ষতা অনেকটা মজবুত করলেও তিউনিসিয়া বিশেষ করে আন নাহদা ক্রমে লিবিয়ার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। রশিদ আল ঘানুশি ত্রিপোলির তুরস্ক-কাতার সমর্থিত জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে ‘সমর্থন ঘোষণা’ করেছে। এ অবস্থায় তিউনিসিয়ায় ক্ষমতা থেকে আন নাহদাকে উৎখাত না করলে আগামীর লিবিয়ায় সৌদি-আমিরাত-ফ্রান্স বলয়ের স্বার্থ বৃহৎ সংকটে পড়বে।
তিউনিসিয়ায় বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আন নাহদা পার্টিও ব্রাদারহুডের আদর্শিক জায়গায় মিল রেখে চলে। লিবিয়া ও সুদানের আসন্ন সম্ভাব্য নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে তিউনিসিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল জরুরি। তা না হলে তিউনিসিয়ার সাহায্যে লিবিয়া ও সুদানের আসন্ন নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচনে ভালো করার সম্ভাবনা বেশি।
তৃতীয়ত, মুসলিম ব্রাদারহুডের পুনরুত্থান রোধ করা। পশ্চিমের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সিসি কর্তৃক নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে উৎখাতের পর শুরু হওয়া দুর্দিনের ইতি টানতে পারেনি মুসলিম ব্রাদারহুড; বরং নানা দেশ ব্রাদারহুডকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠনের’ তকমা দিয়েছে, যে তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে জর্ডান। ম্রিয়মাণ হয়ে গিয়েছিল প্রায় শতবর্ষী এই সংগঠন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আঙ্কারা, দোহা, তুনিস এবং স্বল্প পরিসরে তেহরানের প্রত্যক্ষ সমর্থনে হালে পানি পেয়েছে ব্রাদারহুড। তিউনিসিয়ায় বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আন নাহদা পার্টিও ব্রাদারহুডের আদর্শিক জায়গায় মিল রেখে চলে।লিবিয়া ও সুদানের আসন্ন সম্ভাব্য নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে তিউনিসিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল জরুরি। তা না হলে তিউনিসিয়ার সাহায্যে লিবিয়া ও সুদানের আসন্ন নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচনে ভালো করার সম্ভাবনা বেশি।
লিবিয়ায় ব্রাদারহুডের শক্তিশালী অবস্থান ভূমধ্যসাগরের বর্তমান অবস্থানকে সম্পূর্ণভাবে তুরস্কের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। আরাম ভঙ্গ হবে পশ্চিমের পছন্দের স্বৈরাচার সিসির আর সৌদি বলয়ের। তাই এই বিক্ষোভের অন্যতম উদ্দেশ্য ব্রাদারহুড দমন। যেমনটা কয়েক মাস আগে লেবাননে হিজবুল্লাহকে দমনের নামে এবং ২০১৯ সালে সুদানে ওমর আল বশিরের বিরুদ্ধে সুদানে বিক্ষোভ হয়েছিল।
আঞ্চলিক রাজনীতির এই হিসাব-নিকাশের সঙ্গে ইসরায়েলের সঙ্গে তিউনিসিয়ায় সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিষয়টিও জড়িত। সৌদি বলয় ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপনে তিউনিসিয়াকে চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী হিচেম মেচিচি এই সম্ভাবনার কথা নাকচ করে দিয়েছেন।
বিক্ষোভ ক্রমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রেসিডেন্ট সাইয়িদ এবং প্রধানমন্ত্রী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য কাজ বেগবান করবেন বলে কথা দিয়েছেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা আশ্বস্ত হয়নি। বিক্ষোভকারীদের বিশাল একটি অংশ তরুণ। এই তরুণেরা আঞ্চলিক রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝতে চায় না। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের ঋণের শর্তগুলো চোখ বুলিয়ে দেখতে চায় না। শুধুই দারিদ্র্যের শোষণ থেকে মুক্তি চায়। সম্ভবত, এই বিক্ষোভকে পুঁজি করে সৌদি-আমিরাত-ফ্রান্স বলয় তিউনিসিয়ার রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে। তিউনিসিয়ায় যেকোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন লিবিয়ার আসন্ন রাজনৈতিক সমঝোতাকে বিনষ্টসহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সিসিদের উৎসাহিত করবে।
রাহুল আনজুম মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক।