বিশ্বব্যাপী ২৯ অক্টোবর বিশ্ব স্ট্রোক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর এ দিনটি পালিত হয়ে আসছে, যার মুখ্য উদ্দেশ্য স্ট্রোক নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। বিভিন্ন মেডিকেল ফাউন্ডেশন, স্বাস্থ্যসচেতনতা ক্লাব এবং এরূপ অন্যান্য সামাজিক সংঘ এই দিন স্ট্রোকের কারণ ও প্রতিকার প্রসঙ্গে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানা রকম প্রতিযোগিতা, বক্তৃতা ও অন্যান্য গঠনমূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। এ বছর বিশ্ব স্ট্রোক দিবসের স্লোগান ‘জয়েন দ্য মুভমেন্ট’ স্লোগানটি বেছে নেওয়া হয়েছে।
স্ট্রোক মূলত মস্তিষ্কের রক্তনালির সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি রোগ। বিশ্বব্যাপী যেসব রোগের কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে, তার মধ্যে অন্যতম স্ট্রোক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুর হারের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। ক্রুড ডেথ রেট হিসেবে প্রতি হাজারে বাংলাদেশে মৃত্যু ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। এ দেশে মৃত্যু এবং পক্ষাঘাতের তৃতীয় প্রধান কারণ হিসেবে স্ট্রোককে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। সামগ্রিক বিবেচনায় অনেকেরই মনে হতে পারে, স্ট্রোক একটি ভয়াবহ ও দুরারোগ্য ব্যাধি। বাস্তবে স্ট্রোক অনেকাংশেই নিরাময়যোগ্য, যার প্রতিকারে ও প্রতিরোধে পূর্বসচেতনতা অনেকখানি গুরুত্ব বহন করে। নিয়মিত পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসসহ দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন দিককে আয়ত্তের মধ্যে রেখে স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশেই রোধ করা সম্ভব।
স্ট্রোক প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানতে হলে প্রথমেই আমাদের এর ধরন সম্পর্কে জানতে হবে। স্ট্রোক মূলত দুই প্রকার—ইস্কেমিক স্ট্রোক এবং হেমোরেজিক স্ট্রোক। উভয় প্রকার স্ট্রোকেই মূলত ব্যক্তির মস্তিষ্কের রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার প্রভাব পর্যায়ক্রমে তার শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ওপর পড়ে। স্ট্রোকের সঙ্গে হার্ট বা হৃৎপিণ্ডের কোনো সম্পর্ক নেই, যেটি অনেকেই ভুলবশত ধারণা করে থাকেন। ইস্কেমিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের রক্তনালি জমাট বাঁধা রক্ত দ্বারা আক্রান্ত হয়। শরীরের কোনো অংশ থেকে মস্তিষ্কে জমাট বাঁধা রক্ত সঞ্চালিত হলে মস্তিষ্কের ওই অংশের স্বাভাবিক ক্রিয়া ব্যাহত হয়। হেমোরেজিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে রক্তনালি ছিঁড়ে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্তপাত ঘটতে পারে। রোগীর শারীরিক অবস্থা এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার দ্রুততার ওপর স্ট্রোকের পরিণতি অনেকাংশে নির্ভর করে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা দেওয়া না গেলে রোগী মারাও যেতে পারেন।
স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীর শরীরে কিছু বিশেষ উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা দেয়। এর মধ্যে প্রাথমিক এবং দ্রুত চিহ্নিত করার মতো লক্ষণ হলো শরীরের যেকোনো এক পাশের অংশ অবশ হয়ে আসা। যেহেতু স্ট্রোকের ক্ষতিকর প্রভাব প্রথম মস্তিষ্কের ওপরেই পড়ে, তাই মস্তিষ্কের যে অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওই অংশের নিয়ন্ত্রণাধীন অঙ্গগুলো স্ট্রোকের কারণে অবশ হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের ডান অংশ আক্রান্ত হলে শরীরের বাঁ হাত, বাঁ পা এবং মুখমণ্ডলের বাঁ অংশ অবশ হয়ে যেতে পারে; একইভাবে বাঁ অংশ আক্রান্ত হলে অবশ হতে পারে ডান হাত, ডান পা ও মুখমণ্ডলের বাঁ অংশ। মাথাব্যথা, বমিভাব, খিঁচুনি, চোখের দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসা, শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা, অজ্ঞান হয়ে পড়া, কথা জড়িয়ে আসা প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিলেই রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা একটি সূত্রের উল্লেখ করে থাকেন, যেটি হলো। যেখানে ফেসিয়াল ড্রুপিনেস অর্থাৎ মুখমণ্ডলের বিকৃতি, আর্ম উইকনেস অর্থাৎ হাত বা বাহুর দুর্বলতা, স্পিচ ইম্পেডিমেন্ট অর্থাৎ কথা জড়িয়ে আসা এবং টাইম ফর ইমারজেন্সি ট্রিটমেন্ট অর্থাৎ দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়। এই সূত্রটি মনে রাখলে বিপদের সময় দ্রুত লক্ষণ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হতে পারে।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর চিকিৎসাব্যবস্থার সাহায্যে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর উপায়ে স্ট্রোকের চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে। থ্রম্বোলাইসিস এবং থ্রম্বেকটমির মতো উন্নত চিকিৎসাপদ্ধতির দ্বারা ইনজেকশন এবং স্টেন্টের ব্যবহার করে স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীদের সুস্থতার পথে চালিত করা এখন সহজতর হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনে জটিলতর পদ্ধতির মাধ্যমে সার্জারি, সার্জিক্যাল ক্লিপিং এবং অনুরূপ বিভিন্ন পদ্ধতির সাহায্যে জমাটবদ্ধ রক্ত যাতে মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে না পারে, তার নিশ্চয়তা প্রদান করা হচ্ছে।
একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিমিত শরীরচর্চা করা, মানসিক চাপ পরিহার করা এবং সুষ্ঠু খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে স্ট্রোকের ঝুঁকি থেকে অনেকাংশেই মুক্ত থাকা সম্ভব।
তবে, যত উন্নত চিকিৎসাপদ্ধতিই আবিষ্কৃত হোক না কেন, সবার জন্য বিশেষজ্ঞদের প্রথম ও প্রধান অনুসরণীয় নির্দেশনা হলো স্ট্রোক হওয়ার আগেই নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত পন্থায় গুছিয়ে তোলা। একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিমিত শরীরচর্চা করা, মানসিক চাপ পরিহার করা এবং সুষ্ঠু খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে স্ট্রোকের ঝুঁকি থেকে অনেকাংশেই মুক্ত থাকা সম্ভব। উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করার মাধ্যমে শরীরের কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত। পাশাপাশি ধূমপান বা মদ্যপানের মতো স্বভাবও পরিহার করা উচিত। নিয়মিত হেঁটে, দৌড়ে কিংবা দড়িলাফ দিয়ে শরীরকে সচল রাখা স্ট্রোকসহ অনেক রোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে নিয়মিত রক্তে সুগারের পরিমাণ পরীক্ষা করারও পরামর্শ দেওয়া হয়।
বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালনের পেছনে জনসাধারণের মধ্যে একটি সুষ্ঠু জীবনাচারের তাগিদ গড়ে তোলাই মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। এ বছরের বিশ্ব স্ট্রোক দিবসে ‘জয়েন দ্য মুভমেন্ট’ স্লোগান অনুসারে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা তাদের মূলত সুস্থতার বাণীই প্রচার করবেন।
ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সের (এনআইএনএস) পরিচালক ও অধ্যাপক