বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো সম্প্রতি প্রায় ৩৫টি গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘নেট মিটারিং গাইডলাইন ২০১৮’–এর আওতায় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ওই গাইডলাইন জারি করেছিল। স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় প্রায় পাঁচ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎশক্তি নবায়নযোগ্য উৎস থেকে গ্রিডে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ–জাতীয় চুক্তি আরও অনেক হবে বলে আশা করা যায়। চুক্তির অধীনে যোগ্য গ্রাহক নিজ মালিকানার গৃহস্থালি, বাণিজ্যিক বা শিল্পকারখানার ছাদ বা উন্মুক্ত স্থানে স্থাপিত সৌরবিদ্যুৎ প্যানেলে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ (গ্রাহক নিজে ব্যবহার করার পর বাড়তি বিদ্যুৎ) বিতরণ কোম্পানির কাছে (বিদ্যুৎ গ্রিডে) নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করবেন। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের সরবরাহকৃত নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ করতে বিতরণ কোম্পানি গ্রাহকের গ্রিড থেকে নেওয়া বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে মূল্য সমন্বয় করবে। ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি (যেমন সূর্যের আলো) উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে উৎসাহ সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রকাশিত গাইডলাইন অনুযায়ী, এ পদ্ধতি ব্যবহার করে গ্রাহক নিজের অনুমোদিত লোডের ৭০ শতাংশ পর্যন্ত জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে পারবেন। নেট মিটারিং পদ্ধতির আওতায় প্রাথমিকভাবে সর্বোচ্চ এসি আউটপুট তিন মেগাওয়াটে সীমিত রাখা হয়েছে (সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল থেকে ‘ডিসি’ বা ‘ডাইরেক্ট কারেন্ট’ উৎপাদিত হয়, যা গ্রিডে সরবরাহের আগে ইনভার্টারের মাধ্যমে এসি বিদ্যুতে রূপান্তর করা হয়)। গ্রাহকের আমদানিকৃত (গ্রিড থেকে নেওয়া) বিদ্যুৎশক্তি তার রপ্তানিকৃত (নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের গ্রিডে সরবরাহকৃত অংশ) বিদ্যুৎশক্তি সমান হলে গ্রাহকপ্রতি বিলিং সময়কালে কেবল ডিমান্ড চার্জ ও অন্যান্য নির্ধারিত চার্জ (সাধারণ গ্রাহকের ওপর সচরাচর প্রযোজ্য) পরিশোধ করেন। কোনো বিলিং সময়কালে নেট মিটারিং পদ্ধতির আওতায় গ্রাহকের বিদ্যুৎ রপ্তানির পরিমাণ আমদানির চেয়ে বেশি হলে তা ক্রেডিট হিসেবে পরবর্তী বিলের সঙ্গে সমন্বয়ের ব্যবস্থা থাকে। নির্দিষ্ট মিটার স্থাপনের মাধ্যমে গ্রাহক কী পরিমাণ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন করছেন, গ্রিড থেকে কত বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন, কী পরিমাণ উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ গ্রিডে সরবরাহ করছেন, তা নিয়মিত পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা সিস্টেমে সংযুক্ত করা হয়। বাড়ি, বাণিজ্যিক স্থাপনা, শিল্পকারখানার ছাদ বা উন্মুক্ত স্থানে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করে নিজে ব্যবহার ও উদ্বৃত্ত অংশ গ্রিডে সরবরাহের ব্যবস্থা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দীর্ঘদিন বেশ চালু আছে। বিলম্বে হলেও আমাদের দেশে এর যাত্রা শুরু হলো।
২০২০ সালের মধ্যে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে উৎপাদন ও সরবরাহ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কাজ করছে। এখন পর্যন্ত গ্রিড বিদ্যুতের আওতার বাইরে প্রায় ২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের ক্যাপটিভ বিদ্যুৎসহ মোট ২০ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের সামর্থ্য তৈরি হয়েছে (ভারত থেকে আমদানি করা ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎসহ। দেশে গ্রিড সংযোগের বাইরে মোট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এখন পর্যন্ত প্রায় ৩২৬ মেগাওয়াট।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সবচেয়ে বাস্তবানুগ উৎস সৌরশক্তি। আমাদের দেশে জমির স্বল্পতার কারণে বড় পরিসরে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়া নিয়ন্ত্রিত রাখতে হচ্ছে (এক মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে তিন একরের বেশি বাধাহীন জায়গা দরকার হয়)। এ দেশে বায়ুশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুকূল জায়গা খুবই কম। নতুন জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুযোগও কার্যত অনুপস্থিত। ফলে বিদ্যমান প্রযুক্তির জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিদ্যুৎ আমদানির ওপর এ দেশের নির্ভরতা থাকছেই। এ কারণে বাসাবাড়ি, বাণিজ্যিক ভবন, শিল্পকারখানার ছাদে সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেম বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয় বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
সৌরশক্তি ও অন্যান্য উৎস (কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপিত ক্ষমতা, বায়ুশক্তিচালিত বিদ্যুৎ স্থাপনাসহ) মিলিয়ে দেশে মোট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপিত ক্ষমতা এখন প্রায় ৫৫৯ মেগাওয়াট (৩ শতাংশের কম)। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর (জ্বালানি তেল, গ্যাস, কয়লা) নির্ভরতা ব্যাপক। সরকার সবার জন্য বিদ্যুৎ–সুবিধা নিশ্চিত করতে জ্বালানি বহুমুখী করার কৌশলকে গুরুত্ব দিচ্ছে। সে ধারাবাহিকতায় জীবাশ্ম জ্বালানির পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন এখন পর্যন্ত বেশ ব্যয়বহুল। বিদ্যমান প্রযুক্তিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে সুলভ মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহে জার্মানির মতো (পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ ও ইউরোপের বৃহত্তর অর্থনীতি) দেশও হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের বিদ্যুৎ ক্রয়ের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা আছে। ফলে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা দ্রুত কাটছে না। সরকার গ্রাহকদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে এবং গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ কম ব্যবহার করতে উৎসাহিত করছে।
জার্মানির এখন প্রায় ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন করার সামর্থ্য আছে। সম্প্রতি দেশটির এক কমিশন বলেছে, তাদের অন্তত ২০৩৮ সাল পর্যন্ত কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে। জার্মান অর্থনীতি ও তার বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা সামর্থ্যের সঙ্গে অধিক জ্বালানি ব্যবহারকারী শিল্প-বাণিজ্যের সম্পর্ক নিবিড়। দেশটি এখনো নিজেদের পারমাণবিক বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, উপরন্তু প্রতিবেশী ফ্রান্স থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ এবং পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরি থেকে কয়লা বিদ্যুৎ আমদানি করে। কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কমালে জার্মানির শিল্প–বাণিজ্যের প্রতিযোগিতা সামর্থ্য হুমকির মুখে পড়বে বলে সে দেশের ব্যবসায়ী নেতারা আশঙ্কা করেন। আরও বেশি নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহার করার ক্ষেত্রে জার্মানিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বাড়তি ব্যয় ও ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের বাড়তি মূল্যের চাপ মোকাবিলার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হয়। সে কারণে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির অন্যতম উদ্যোক্তা হয়েও জার্মানি তার ঘোষিত ২০২০ সালের কার্বন নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে জার্মানি প্যারিস সম্মেলনের লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে থাকলে ইউরোপের অন্য দেশগুলো তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে এমন নিশ্চয়তা নেই।
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো এবং কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানি পরিত্যাগের দাবি বাড়ছে। এই দাবি পূরণ করতে হলে বাস্তবের বাধাগুলো কীভাবে অতিক্রম করা সম্ভব, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা ও আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি টেকসই জ্বালানি উন্নয়ন কৌশল আয়ত্ত করা অত্যন্ত জরুরি।
ড. মুশফিকুর রহমান খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক