উদয়ের পথে শুনি কার বাণী-৮২
সৈয়দ আকবর হোসেন
শহীদ বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম
পেশায় আইনজীবী ও সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন সৈয়দ আকবর হোসেন। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি করতেন।
সৎ, সাহসী ও স্বাধীনচেতা ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হন।
পরে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন।
সৈয়দ আকবর হোসেন আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকায়। ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ি সরাইলে যান। তিনি বাড়িতে যাওয়ার পর তাঁর বাড়িতে প্রতিদিন অনেক লোক আসত।
এটা তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এলাকার পাকিস্তান সমর্থক লোকজন পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে জানিয়ে দেয়, তাঁর বাড়িতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধপক্ষের লোকদের মিটিং হয়।
সেনারা সৈয়দ আকবর হোসেনের খোঁজে তাঁর গ্রামে এলে তিনি পালিয়ে আগরতলা যান। সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের নানা কাজে জড়িয়ে পড়েন।
তাঁর বাড়ি সীমান্তের কাছে হওয়ায় মাঝে মাঝে তিনি বাড়ি আসতেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ৩ ডিসেম্বর বাড়িতে আসার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তিনি ধরা পড়েন।
৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকেসহ ৪০ জনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কুডুলিয়া খালের পাড়ে গুলি করে হত্যা করে।
এ সম্পর্কে আরও জানা যায় তাঁর ছেলে আইনজীবী সৈয়দ তানবির হোসেনের কাছ থেকে।
তিনি বলেন, ‘ঢাকার বড় মগবাজারে নয়াটোলায় ছিল আমাদের বাসা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাবা আমাদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে আসেন।
বাবা যেহেতু রাজনীতি করতেন, তাই তাঁর কাছে প্রতিদিনই লোকজন আসতেন যুদ্ধের সর্বশেষ খবর জানার জন্য। কিছুদিন পর থেকে সরাইল এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আনাগোনা শুরু হয়।
তখনো বাবার কাছে লোকজন আসতে থাকে। কিছুদিন পর আমার চাচা সৈয়দ আফজল হোসেন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে ভারতে যান।
‘দেশের অন্যান্য এলাকার মতো সরাইলেও ছিল পাকিস্তানের সমর্থক ও সেনাবাহিনীর অনুচর।
তারা বাবার কাছে লোকজন আসাকে সহজভাবে নেয়নি। তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে বাবার নামে নালিশ করে এবং জানায় আমাদের বাড়িতে জয় বাংলার মিটিং হয়।
এ সমস্ত সংবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে বাবার খোঁজে একদিন গ্রামে আসে।
তখন বাবা পালিয়ে আগরতলা চলে যান। সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের কাজে জড়িয়ে পড়েন। মাঝে মাঝে আমাদের দেখার জন্য গোপনে বাড়িতে আসতেন।
তাঁর বাড়িতে আসার এবং মুক্তিযুদ্ধের কাজে জড়িয়ে পড়ার খবর গোপন থাকেনি। স্বাধীনতাবিরোধীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে বাবার খবর নিয়মিত পৌঁছাতে থাকে।
সেনাবাহিনীও তাঁকে ধরার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছিল।
‘৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী স্বাধীনতাবিরোধীদের সহায়তায় বাবাকে আটক করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিয়ে যায়। আমার দাদা খবর পেয়ে চেষ্টা করেন বাবাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। কিন্তু তাঁর চেষ্টায় কোনো কাজ হয়নি।
এদিকে বাবা আটক হয়েছেন খবর পেয়ে আমার মুক্তিযোদ্ধা চাচা বাড়িতে এসেছিলেন। স্বাধীনতাবিরোধীরা কীভাবে যেন তাঁর আসার খবরও পেয়ে যায়।
৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা আমাদের বাড়িতে অতর্কিতে আক্রমণ করে চাচাকেও ধরে নিয়ে যায়।
‘৭ ডিসেম্বর বাড়িতে খবর আসে, ৬ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি সেনারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কুডুলিয়া খালের পাড়ে বাবা-চাচাসহ মোট ৪০ জনকে গুলি করে হত্যা করেছে।
এই খবর পেয়ে কেউ সেখানে যেতে সাহস পাচ্ছিলেন না। ৮ ডিসেম্বর কুট্টাড়ার মালেক ড্রাইভার আমাদের বাড়ির ও গ্রামের কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ৪০টি লাশের মধ্যে থেকে আমার বাবা ও চাচার লাশ বের করে আনেন।
৪০ জনের মধ্যে অধ্যাপক লুৎফর রহমানও ছিলেন।’ (সাক্ষাৎকার ১৪ মার্চ ২০১৫)।
সৈয়দ আকবর হোসেনের জন্ম ১৯৩৫ সালে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল থানার আলীনগর গ্রামে।
তিনি বকুল মিয়া নামে পরিচিত ছিলেন। বাবা সৈয়দ সুয়েব আলী (বাচ্চু মিয়া), মা আবেদা খাতুন। বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান।
তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি স্থানীয় স্কুলে। সরাইলের অন্নদা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে।
এখান থেকে আইএ পাস করে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এরপর কিছুদিন সরকারি চাকরি করেন।
পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাস করে আইন পেশায় যোগ দেন।
সৈয়দ আকবর হোসেন এক ছেলে ও তিন মেয়ের জনক।
মেয়ে সৈয়দা সুরাইয়া আকতার, সৈয়দা সুলতানা আকতার ও সৈয়দা ফারজানা খানম। সবাই গৃহিণী। স্ত্রী নুরুল আকতার।
প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (সপ্তম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৮) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
[email protected]