আজ ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সেনাশাসকদের ক্ষমতা দখল করার এক বছর পূরণ হচ্ছে। সামরিক বাহিনীর এই ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া একটি অধিকতর প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার দিকে ধাবমান প্রক্রিয়াকে একেবারে উল্টিয়ে দিয়েছে এবং দেশটিকে গভীর রাজনৈতিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। অভ্যুত্থানটি অনেক পর্যবেক্ষককে অবাক করেছিল, কারণ মিয়ানমারে রাজনীতিক ও সামরিক বাহিনী যৌথভাবে যে রাজনৈতিক কাঠামো দাঁড় করিয়েছিল, তা অনেকটাই সামরিক বাহিনীর পক্ষে ঝুঁকে ছিল। ২০০৮ সালের সংবিধান নিশ্চিত করেছিল, আইনসভায় ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এর বাইরে প্রতিরক্ষা ও সীমান্তবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদগুলো সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত ছিল।
অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন আধা গণতান্ত্রিক সরকার কোনো দিক থেকেই সেনাবাহিনীর অর্থনৈতিক স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করেনি। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগের বিরুদ্ধে সু চি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বক্তব্য দিয়ে সেনাবাহিনীকে রক্ষা করে গেছেন। তবে ২০২০ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল সেনাবাহিনীর প্রত্যাশিত হয়নি—সম্ভবত এটিই সেনাবাহিনীর একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে থাকতে পারে। সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ওই নির্বাচনে ৭০ শতাংশের বেশি আসনে জয়লাভ করেছে।
এনএলডির ব্যাপক বিজয় সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে এ উদ্বেগ তৈরি করেছিল যে এ বিপুল বিজয়ের সুবাদে সু চি আইনসভা এবং নির্বাহী কাঠামোতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি কমানোর জন্য রাজনৈতিক সংস্কারের সূচনা করতে পারেন। অতীতে তিনি প্রকাশ্যে তাঁর এমন ইচ্ছা প্রকাশও করেছিলেন। সম্ভবত এ কারণেই সেনা কর্মকর্তারা একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শাসনপ্রক্রিয়ার ওপর তাঁদের দখল সুসংহত করতে চেয়েছেন। এর অংশ হিসেবে তাঁরা নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে সু চি এবং প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ বেশির ভাগ বেসামরিক নেতৃত্বকে আটক করে জেলে পাঠিয়েছেন। পরবর্তীকালে প্রতিরক্ষা বিভাগের কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক পরিষদ শাসনযন্ত্রের দায়িত্ব নিয়ে নেয়।
তবে কিছুদিনের মধ্যেই এটি স্পষ্ট হয়েছে, তাতমাদা নামে পরিচিত সেনাবাহিনীর হাতে দেশটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। জেনারেল মিন অং হ্লাইং নিজেও স্বীকার করেছেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দেওয়া বিক্ষোভের মাত্রা তাঁদের বিস্মিত করেছে। বেসামরিক কর্মচারী, ডাক্তার, এমনকি পুলিশ অফিসারসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ আইন ভাঙা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন এবং তাঁরা অবিলম্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানান।
সামগ্রিকভাবে মিয়ানমারে এক বেদনাদায়ক অচলাবস্থা বিরাজ করছে। একদিকে সামরিক বাহিনী সরকারের ক্ষমতা দখল করেছে কিন্তু দেশটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই। অন্যদিকে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো কিছু জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, কিন্তু তারা তাতমাদার উল্লেখযোগ্য সামরিক পরাজয় ঘটাতে পারেনি। এ অচলাবস্থা কাটবে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না
ইতিমধ্যে ক্ষমতাচ্যুত সংসদ সদস্যদের দ্বারা ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) নামের একটি সমান্তরাল জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করা হয়। এনইউজি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের ডাক দেয় এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) নামের একটি গণ প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করা হয়। যদিও জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো জনগণের কাছ থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন পাচ্ছে, তারপরও তারা তাতমাদার নিয়ন্ত্রণে থাকা বিশাল এলাকা কবজা করতে পারছে না। তারা এখনো তাদের কার্যক্রম সমন্বয় করতে পারছে না। অন্যদিকে আধুনিক রাস্তাঘাট হওয়ার সুবাদে সেনাবাহিনী আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত সহজেই সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে অভিযান চালাতে পারছে।
সামগ্রিকভাবে মিয়ানমারে এক বেদনাদায়ক অচলাবস্থা বিরাজ করছে। একদিকে সামরিক বাহিনী সরকারের ক্ষমতা দখল করেছে কিন্তু দেশটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই। অন্যদিকে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো কিছু জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, কিন্তু তারা তাতমাদার উল্লেখযোগ্য সামরিক পরাজয় ঘটাতে পারেনি। এ অচলাবস্থা কাটবে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে সু চিকে কয়েক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং অনেক প্রতিবাদকারীকে দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা মোতাবেক হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশ বেছে বেছে মিয়ানমারের লক্ষ্যবস্তুতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে মিয়ানমারের ভেতরকার অবস্থা পরিবর্তনের ক্ষমতা তাদের সীমিত। অন্যদিকে চীন আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে তাতমাদাকে সমর্থন দিয়েছে। বিনিময়ে তাতমাদা মিয়ানমারে চীনা প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করছে।
মিয়ানমারের পরিস্থিতি এ অবস্থায় গড়ানোটা ভারতের জন্য খুবই হতাশাজনক। সংঘাতের ফলে মিয়ানমারের উদ্বাস্তুদের প্রবাহ বেড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে মিয়ানমারে ভারতীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো তাদের কর্মকাণ্ড বাড়ানোর জন্য আরও বেশি জায়গা ও অস্ত্র খুঁজে পেতে পারে। সব মিলিয়ে এক বছরে মিয়ানমার পরিস্থিতি দেশটির সেনাশাসক, সেখানকার রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষের জন্য সুখকর কিছু বয়ে আনেনি। দেশটির প্রতিবেশীদের মধ্যেও এ অবস্থা শুধু অস্বস্তি আর উদ্বেগই বাড়িয়েছে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● সঞ্জয় পুলিপাকা ভারতীয় লেখক ও গবেষক