দীর্ঘদিন পর আমার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলায় সায়দাবাদে কজন বন্ধুকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বন্ধুবর অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জামিল মজিদ বলল, ‘হান্নান ভাই, আমি ঢাকা শহরে বেড়ে উঠেছি। তারপর সারাটা জীবন সরকারি চাকরিতে বাইরে কেটেছে। একটা গ্রাম দেখার আমার বড্ড ইচ্ছা।’
সরকারি চাকরিতে আব্বা ঘন ঘন বদলি হওয়ায় চল্লিশের দশকের শেষ তিন বছর আমি হোস্টেলে থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তদানীন্তন বিখ্যাত অন্নদা হাইস্কুলে লেখাপড়া করে ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পাস করি। আব্বা তখন ফরিদপুরে। তাই ছোটখাটো ছুটিতে প্রায়ই আমি গ্রামের বাড়িতে যেতাম। অনেক স্মৃতি। সকালে রেলগাড়িতে রওনা হয়ে গঙ্গাসাগর স্টেশনে নেমে ধানখেতের আইল ও তিতাস নদের পাড় ঘেঁষে পাঁচ মাইল হেঁটে, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক পার হয়ে তিন লাখ পীরের মোড় ছাড়িয়ে যখন আমি বাড়িতে পৌঁছাতাম, তখন সূর্য দিগন্তের অন্তরালে প্রায় অস্তমিত। আর এখন গাড়িতে করে কুমিল্লা-সিলেট সড়কের ২০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে গ্রামে পৌঁছাতে লাগল মাত্র আধা ঘণ্টা।
গ্রামের প্রবেশপথেই বাঁ দিকে চোখ পড়ল সায়দাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, যা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সায়দাবাদ আদর্শ কলেজ নামে শুরু হয়েছিল। কিছুটা এগোতেই পরপর চারটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল। একটু পর দেখি সায়দাবাদ হাইস্কুল, যেখানে ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়ে। শিক্ষা প্রসারের সুযোগ-সুবিধার যে অগ্রগতি হয়েছে, তা দেখে বিস্মিত হই। আমার আব্বা প্রতিদিন যাতায়াতে ১০ মাইল হেঁটে কসবা হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। আর এখন গ্রামেই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা যায়।
পাকা রাস্তায় চলতে চলতে চারপাশের দিকে চেয়ে দেখি এখন প্রায় সব বাড়িই পাকা। ছাদে টেলিভিশনের ডিশ অ্যানটেনা। আগে ছেলেবেলায় সেখানে দেখেছি শণের কিংবা মাটির ঘর। অবিশ্বাস্য পরিবর্তন। বুঝতে পারি গ্রামের ছেলেরা মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া অথবা ইতালিতে কাজ করে দেশে টাকা পাঠিয়ে এটা সম্ভব করেছেন। আমাদের গাড়ি একেবারে আমাদের বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়াল। আমরা এসেছি শুনে আমার আট চাচাতো ভাইয়ের বউয়েরা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তক্ষুনি আমার মনে পড়ল ছেলেবেলায় বাড়িতে বাইরের কেউ এলে দাদি, চাচি ও আমার চাচাতো দুই বোন আনোয়ারা ও রোকেয়া বেড়ার ওপার থেকে উঁকি মেরে দেখতেন কে এসেছেন।
একটু পর চাচাতো ভাই শরীফের স্ত্রী হেলেনা একটা ট্রেতে টি-সেটে ইস্পাহানি টি-ব্যাগ দিয়ে ও প্যাকেটে হক বিস্কুট নিয়ে এলেন। হেলেন একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ায়। শরীফ কোথায়—জিজ্ঞেস করলে হেলেন বলেন, আমন ধান কাটা পড়েছে, জমিতে গেছে। ওর কথা শেষ হতে না হতেই শরীফ এসে হাজির। পরনে টি-শার্ট ও জিনসের প্যান্ট, পায়ে স্যান্ডেল। চাষির এ কী চেহারা? আমার মনে পড়ে আবিকুল চাচা, জাহের চাচা ও আমাদের সার্বক্ষণিক খেতমজুর, যাকে আমি ফালু চাচা বলতাম, তাঁরা পরনে গামছার নেংটি পরে কাঁধে লাঙল ও সঙ্গে গরু নিয়ে চাষ করতে যেত। শরীফ জানালেন, এখন ট্রাক্টর দিয়ে চাষ হয় এবং মেশিন দিয়ে ধান কাটা ও ছাঁটা হয়। দুপুরে খাওয়ার আগে শরীফ আমাদের তাঁর বাথরুমে নিয়ে গেলেন। এখন আধুনিক পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা অতি অল্প খরচেই সব বাড়িতেই হয়েছে। আগে দেশের বাড়িতে এলে বাথরুমের কথা বললে দাদি বলত, নাইল্যা খেতে যাওগা।
শরীফের ঘরেই আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। আমাদের ডাইনিং টেবিল ও চেয়ারে খেতে বসাল। পাশেই আলমারিতে চীনামাটির ডিনার ও টি-সেট, টেলিভিশন ও একটা ফ্রিজ। টেলিভিশনে আবদুল হাদী গাইছিল ‘একবার কেউ যদি ভালোবাসতো...’। আমার মনে পড়ে যায় আনিস চাচার বিয়ের সময় জাহের চাচা চৌধুরীদের বাড়ি থেকে একটা কলের গান নিয়ে এসেছিল। কানন দেবীর গাওয়া গান ‘তুফান মেল যায়’ এবং ‘যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে এঁকে থাকো কারও ছবি সে কথা ভুলিয়া যেও’। শরীফ বললেন, পল্লী বিদ্যুৎ আসায় এবং কিস্তিতে কেনা যায় বলে এখন সব বাড়িতেই টিভি ও ফ্রিজ আছে। আমি খাবারে স্বাদের তারতম্য বুঝতে পারি না। কেমন করে বুঝব? এখন সবাই সয়াবিন তেল ও প্যাকেটের মসলা ব্যবহার করে। বাটা মসলা ও ঘানির খাঁটি সরিষার তেল কিংবা লাকড়ির চুলা কেউ ব্যবহার করে না। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে। মাছ-তরকারি সবাই বাজার থেকে কেনে। তখন আবিকুল চাচা বাজারে যেতেন তামাকের রাব, গায়ে মাখা, কাপড় কাচা সাবান আর চাচির জন্য জবাকুসুম তেল কিনতে। ছেলেবেলায় বাড়িতে এলে চাচা একটা মাছ ধরা জাল নয়তো কোঁচ নিয়ে বেরিয়ে যেতেন। ফিরে আসতেন বিল থেকে শোল কিংবা বোয়াল মাছ নিয়ে। এখন খাল-বিল-নদী শুকিয়ে গেছে। সবাই পুকুরে চাষের মাছ কিনে খায়।
খাওয়ার পর আমি বাড়ির চারদিকে ঘুরে দেখি। চাচাতো ভাইদের কারও কারও পাকা দালান আবার কারও কারও ভিত ও দেয়াল পাকা। চুন্নু কাতারে থেকে একটা দোতলা বাড়ি করেছেন। বাড়িতে তাঁর বউ সরিফা মেয়ে সইফাকে নিয়ে থাকেন। চুন্নু বছরে একবার দেশে আসেন। নিয়মিত বাবা নান্নুর কাছে টাকা পাঠান। নান্নুর এখন সময় ভালো। দামি পাঞ্জাবি পরে বাজারে যান। রুই-কাতলা ও দেশি মুরগি কেনেন। সরিফা রান্না করে শ্বশুরকে খাওয়ান। নান্নু এখন মহাসুখে আছে। আমি সরিফাকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কি সুখী? সরিফা জবাব দেয় না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। না জানি গ্রামে-গ্রামে কত সরিফা এমন স্বামীবিচ্ছেদে নির্জনে-নিভৃতে চোখের পানি ফেলছেন।
বাড়ির পেছনে দিঘির মতো বড় পুকুরে আমাদের নৌকা বাঁধা থাকত। বর্ষকালে যখন পথ-ঘাট-জমি পানিতে ভরে যেত, তখন নৌকাই ছিল যাতায়াতের একমাত্র বাহন। এখন গ্রামে কেউ নৌকা ব্যবহার করে না। নৌকা শুধু দরজার পোস্টারে দেখতে পেলাম। পুবের ভিটার ঘরে একসময় দাদির একটা বিশাল সিন্দুক ছিল। আমি ভাবতাম, সিন্দুকে দাদির গুপ্ত ধন আছে। পশ্চিমের ভিটার ঘরে একসময় আমাদের একটা পালকি ছিল। আব্বা ছুটিতে বাড়ি এলে আম্মা ওই পালকিতে চড়ে আমাদের বাড়িতে আসতেন এবং তাঁর বাপের বাড়ি যেতেন। এখন পালকি শুধু সিনেমাতেই দেখা যায়।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দিগন্তবিস্তৃত মাঠ গোধূলির আলোছায়ায় ধীরে ধীরে দৃষ্টির অগোচরে চলে যাচ্ছে। আমরা বিদায় নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসার জন্য রওনা হলাম। মনে পড়ে ছেলেবেলায় আমি যখন বাড়ি থেকে স্কুলে ফিরে যেতাম, তখন দাদি, চাচি, আনোয়ারা ও রোকেয়া চোখ ছল ছল করে আমাকে বিদায় জানাতেন। আমাকে অনেকটা পথ এগিয়ে দিত এবং তাকিয়ে থাকতেন যতক্ষণ আমাকে দেখা যায়। বিদায় এখন শুধু লৌকিকতা, প্রাণের ছোঁয়া নেই। গাড়িতে সবাই নিশ্চুপ। কেউ কোনো কথা বলছে না। জামিল মজিদ আমায় বলল, ‘হান্নান ভাই, আপনি কথা বলছেন না। বাড়ি ছেড়ে চলে আসার জন্য আপনার মন খারাপ?’ আমি বলি, আমার মন খারাপ। কারণ, আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম গ্রাম দেখাব—তা দেখাতে পারিনি বলে। জামিল মজিদ বলল, ‘কেন? আপনাদের গ্রাম তো খুব উন্নত। আমি মুগ্ধ, খুব উপভোগ করেছি।’ আমি বলি, আপনি ঠিক বলেছেন। আমার গ্রাম খুব উন্নত। কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম হারিয়ে গেছে। এখন গ্রাম ও শহরের সীমানা একাকার হয়ে গেছে। এখন আর গ্রামের সেই সহজাত-সহজ-সরল-অকৃত্রিম জীবনযাপন, শান্ত সমাহিত পরিবেশ নেই।
এ কেমনতর গ্রাম, যেখানে মাঠে লাঙল আর গরু নিয়ে গামছা পরা কৃষক নেই? এ কেমন গ্রাম, যেখানে শাড়ি পরা ঘোমটা মাথায় গ্রামের বধূ দেখা যায় না? যেখানে শাপলা-শালুক ভরা পুকুরে বক, ডাহুক ও মাছরাঙা পাখির দেখা পাওয়া যায় না। যেখানে গাছে গাছে ঘুঘু, শালিক, দোয়েল ও টিয়া পাখির ডাক শোনা যায় না। যেখানে বাড়িতে গোয়ালঘর নেই, গরু নেই, লাঙল নেই, মই নেই। ঘরের চালায়, মাচায় লাউ, কুমড়ো, শিম নেই। রান্নাঘরে ঢেঁকি নেই। যেখানে মাটিতে পাটিতে বসে কেউ সানকিতে খাবার খায় না। যেখানে মায়াভরা দাদির হাতের পিঠা, মুড়ির মোয়া কিংবা দই, চিড়া, খই পাওয়া যায় না। সন্ধ্যাবেলা পিদিম জ্বলে না। এগুলোই গ্রামের চিরন্তন অনুষঙ্গ, উপকরণ ও আবহ। আমরা যা দেখে এলাম সে তো গ্রাম নয়, দস্তুরমতো শহর; যা বর্তমান সরকারের গ্রাম উন্নয়ন ভাবনার বাস্তব রূপ, আধুনিক সংস্করণ।
আমি গ্রামের উন্নয়নকে স্বাগত ও সাধুবাদ জানাই। কিন্তু তবু কী যেন হারানোর বেদনা অনুভব করি। মন কাঁদে, হাহাকার করে। আমার ছেলেবেলার গ্রাম চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। আমার বলতে ইচ্ছে করে, ‘ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য—লও এ নগর’।
আবদুল হান্নান: সাবেক কূটনীতিক