সিদ্দিকুরের চোখের দিকে তাকাতে পারবেন?
সেই জোড়া চোখের দিকে তাকাতে পারতে হবে, পুলিশের টিয়ার শেল খুব কাছ থেকে যাকে নিশানা করেছিল। অন্ধ ছিলাম বলে আমরা অনেকে হয়তো তা দেখতে পাইনি। সিদ্দিকুরের সেই চোখে তাকাতে পারতে হবে আমাদের। কিষানি মায়ের দিকে চোখভরা আশ্বাস নিয়ে যে দৃষ্টিতে সে বলেছিল, ‘আম্মা, আর দুইটা বছর কষ্ট করো’—সেই দৃষ্টি ফেরাতে হলে তার চোখের অন্ধকারে তাকাতে হবে আমাদের।
সময়ের মূল্য যাঁদের জীবন দিয়ে শোধ করতে হয়, সিদ্দিকুরের সেই মায়ের জন্য দুই বছর মানে আরও কষ্ট, ভাইয়ের আরও মেহনত। পরীক্ষা পেছানো মানে মায়ের আরও কষ্টের দৈর্ঘ্য আরো বাড়া, প্রতিশ্রুতির দুই বছর আরও লম্বা হয়ে যাওয়া। তাই কি ছেলেটি রুটিনসহ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল? মা যখন কিষানি খাটছেন, বড় বোন যখন শ্বশুরবাড়ির ঘানি টানছেন, বড় ভাই যখন ইট-সিমেন্ট মাখাচ্ছেন, সিদ্দিকুর তখন তিন বেলা পেটচুক্তিতে এক বাড়িতে ছাত্র পড়াচ্ছে। এই সময়ের দুখু মিয়া সিদ্দিকুর।
অন্ধকারে টিমটিম আলো ছিলেন সিদ্দিকুরের মা। পৃথিবীর সব দুখু মিয়ার মায়েরা যেমন করেন, ময়মনসিংহের তারাকান্দার এই দুঃখিনী নারীও তা-ই করেছিলেন। অন্যের জমিতে কিষানি খেটে দুই ছেলেকে বড় করেছেন। বড় ছেলে নায়েব আলী। সাধারণত এসব পরিবারে একজন বা দুজন আত্মত্যাগী থাকেন। সিদ্দিকুরের মা-ই একা নন। ছোট ভাইকে আরও উঁচুতে তুলতে বড় ভাই নায়েব আলী মাধ্যমিকের পর পড়া ছেড়ে রাজমিস্ত্রির কাজ নেন। ইট-কাট-সিমেন্ট-রডের কঠিন জগতের এই কোমল প্রাণের মানুষটি বলেছেন, ‘ওর ভবিষ্যৎই ছিল আমাদের ভবিষ্যৎ।’ সিদ্দিকুর বলেছিল, ‘আর দুইটা বছর, তারপর সরকারি চাকরি পামু।’
রাষ্ট্র কি দৃষ্টি হারাচ্ছে?
লাখো তরুণ-তরুণীর দূরের শুকতারা একটা সরকারি চাকরি। এ জন্য তাঁরা অনেক অসাধ্যসাধন করতে পারেন। একদিকে আলিয়া মাদ্রাসা, অন্যদিকে তিতুমীর কলেজ, এর ভেতরে বিসিএস পাসের জন্য ইংরেজি কোচিং। প্রিয় পাঠক, সিদ্দিকুরদের এই অদম্য জেদের বয়স অন্তত এক শ বছর। সেই যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পাটের দাম বাড়ল। তারপর শেরেবাংলার নেতৃত্বে মহাজনি-জমিদারি শোষণের জোয়াল আলগা করা হলো। দুটি ঘটনা বিরাট জাগরণ ঘটিয়ে দিল বাংলাদেশের কৃষকসমাজে। কৃষকের যে আত্মবিশ্বাস জন্মাল, তার থেকেই শুরু হয়েছিল নতুন এক মুক্তিকামী রাজনীতির যাত্রা; যার পরিণতি ছিল মুক্তিযুদ্ধ। সন্তানদের স্কুল-কলেজে পাঠানোয় কৃষকদের বিপুল উৎসাহ, যার পরিণতিতে শিক্ষিত ও আত্মমর্যাদাবান জাতি গঠন বেগবান হয়েছিল। এই দুই মিলিত সংগ্রামের ফসল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র।
এসব কিষান-কিষানিই জাতির প্রকৃত মাতা-পিতা, আর তাঁদের কর্মঠ ও শিক্ষাপ্রেমী পুত্র-কন্যারাই জাতির প্রকৃত সন্তান। তারা উঠে এলেই দেশ উঠে আসে। একজন শিক্ষিত পেশাজীবী-শ্রমিক-অভিবাসী-কৃষক একাই জাতির দশজনের ভারবহন করে চলেন। এই জেদকে ব্যর্থ করে দেওয়া, তার মাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া চোখকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া মানে কৃষকসন্তানদের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে কানা করে দেওয়া, গুঁড়িয়ে দেওয়া। এই দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসই আমাদের শিক্ষার সংগ্রামকে পবিত্র ও মূল্যবান করে তুলেছিল। এই রাষ্ট্র যখন তার ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে বারবার দাঁড়ায়, তখন বুঝতে হয় রাষ্ট্রটি দেখার ক্ষমতা হারাচ্ছে। ভিডিও প্রমাণ থাকা সত্বেও পুলিশর দায় অস্বীকার এবং নির্যাতিত ১২ শত শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করায় তা প্রমাণ হয়। ভিক্টিমকেই দোষ দেওয়াই এখন রীতি।
লোহার চোখের অন্ধ বল
মানুষসহ সব প্রাণীর চোখে একধরনের জ্যোতি থাকে। অন্তরে স্বচ্ছ যে, সংকল্পে অটল যে, তার চোখের জ্যোতি তত উজ্জ্বল। কিন্তু বন্দুকের নলে শুধু অন্ধকার। বন্দুকের গুলিও অন্ধ, কাকে মারছে তা দেখে না। টিয়ার শেলকে ভারী ও গতিশীল করার জন্য এর ভেতরে চোখের মণির মতো লোহার বল থাকে। ট্রিগার করার পর সেই বলটা প্রচণ্ড গরম হয়ে যায়। সম্ভবত সিদ্দিকুরের চোখের মণিতে আঘাত করেছিল ওই তপ্ত লৌহবলগুলো। সে পড়ে যায়, কালো পিচে অশ্রু আর রক্ত মিশে একাকার হয়। ক্ষতবিক্ষত সেই মুখে যেখানে এক জোড়া চোখ থাকার কথা, সেদিকে তাকানোর সাহস হতে হবে ক্ষমতাবানদের। তাহলেই, তাহলেই হয়তো নিজেদের অন্ধত্ব তাঁরা ঘোচাতে পারবেন। বন্দুকের চোখ ক্ষমতার চোখ। সেই চোখ দিয়ে যত দেখবেন, ততই অন্ধ হবেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শত পুত্র মরছে, সিংহাসন আঁকড়ে বসে আছেন অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র। পুত্রদের মৃত্যু চোখে দেখার যন্ত্রণা সইতে হয়নি তাঁকে। অন্ধ ছিলেন বলেই প্রলয়টা টের পাননি। অন্ধ ছিলেন বলেই কি অন্ধ হিংসার শাসন টিকিয়ে রাখতে চাইছিলেন? রাষ্ট্র অন্ধ হলে প্রলয় ঘনিয়ে আসে। খুলনায় ছিনতাইকারী অভিযোগে থানায় নিয়ে এক সবজি বিক্রেতার চোখ উপড়ে নিয়েছে পুলিশ—অভিযোগ যুবকের স্ত্রীর। কিছুদিন আগে রিকশার ব্যাটারি কেড়ে নেওয়ায় রিকশাচালক ক্ষোভে-দুঃখে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগাতে গেলে পুলিশ তাকে বলে, ‘সাহস থাকলে লাগায়া দ্যাখা।’ লোকটি পুলিশের চোখের সামনে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়েছিল। আমরা আগুনটা দেখেছি, জীবিকা কেড়ে নেওয়া ও আত্মহত্যার উসকানি দেখিনি। হয়তো আমরাও অন্ধ ছিলাম।
দায়ী তাহলে ‘কেউ না’?
পুলিশ বলেছে, ভাঙা ফুলের টবের আঘাতে সিদ্দিকুরের চোখ রক্তাক্ত হয়েছে। শাহবাগে বিস্তর গোলাপ ফুলের দোকান। গোলাপের কাঁটায় সিদ্দিকুরের চোখ গেছে, বলতে পারত পুলিশ। হোমারের ওডিসি মহাকাব্যের নায়ক ইউলিসিস এক দৈত্যকে অন্ধ করে দিয়ে বলেছিল, তার নাম ‘কেউ না’। তারপর দৈত্যের বন্ধুরা যতই জানতে চায়, কে তোমার এমন করল? দৈত্য সত্য বলেছিল। বলেছিল, তার নাম ‘কেউ না’। পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন, গুম, বন্ধুকযুদ্ধ, ৫৭ ধারায় কত জীবন তছনছ হচ্ছে। সাভারের এমপি ১৪ জনকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার কথা বলে গর্ব প্রকাশ করেছেন মিডিয়ায়। সমালোচনা উঠলে অতঃপর ক্ষমা চেয়েছেন। তাতেই সব দায় মাফ? দায়ী তাহলে ‘কেউ না’?
পুলিশকে একা দোষ দেওয়ার কিছু নেই। বুলডোজার দিয়ে ট্রাক্টরের কাজ হয় না। হিংসা নিজেই অন্ধ, তাতে কমিয়ে দিচ্ছে আমাদের সত্য দেখার ক্ষমতা। রাজনৈতিক-মতবাদিক ও গোষ্ঠীগত হিংসায় ভাগ হয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। এ রকম অবস্থায় পুলিশ যখন বিরোধী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের অন্যায় পথে দমন করেছে, তখন অনেকে দেখেও দেখিনি, অনেকেই বাহবা দিয়েছি। যখন চাপাতির কোপে তরুণের লাশ পড়েছে, অনেকের চাপা উল্লাস ফাঁস হয়ে গেছে। হিংসার ভাইরাসে যখন দেশ আক্রান্ত, তখন তা থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বাদ থাকেন কীভাবে? আমরা সেই পুলিশও দেখেছি, যিনি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত বাস থেকে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে অনেককে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু উল্টা দিকেও তো কম অন্ধকার জমেনি। খারাপ লোকের জন্য একটি সমাজ ধ্বংস হয় না, সমাজ ধ্বংস হয় যখন তথাকথিত ভাল মানুষেরা আর অন্যায়কে অন্যায় বলতে চান না, তা মেনে নেন। আপনি যদি রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগকারী সংস্থাকে অন্ধভাবে ব্যবহার করেন, তারাও চোখ বুঁজে ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। শাসকেরা যদি অতিমাত্রায় পুলিশ নির্ভর হয়ে পড়ে, তাহলে তারা সীমা ছাড়াবে। দমন-পীড়ন তাদের অভ্যাসে পরিণত হবে। আপনি তখন চাইলেও তাদের ফেরাতে পারবেন না। ক্ষমতার অন্ধত্ব সবচেয়ে বড় অন্ধত্ব, তা সহজে সারে না।
অন্ধদের জন্য আয়না
নোবেল পুরস্কারজয়ী হোসে সারামাগোর ‘ব্লাইন্ডনেস’ বা ‘অন্ধত্ব’ নামের উপন্যাসের জগতে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। সেই গল্পে হঠাৎ এক বিকেলে এক ব্যক্তি অন্ধ হয়ে যায়। অন্ধত্বটা সংক্রামক। যে তার চোখে দেখেছে, সে-ই দৃষ্টি হারায়। তখন দেখা যায় অন্ধ সন্ত্রাস, অন্ধ ভয়, অন্ধ ঘৃণা আর অন্ধ ভালোবাসা। একটা দেশ যখন ক্ষমতা, বিত্ত ও বাসনার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে গেলে একে একে সবাইকে অন্ধত্ব গ্রাস করে। সারামাগোর অন্ধত্বে অন্ধকার ছিল না, তা ছিল প্রচণ্ড সাদা। যাঁরা চোখ হারিয়েছেন, তাঁরা কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত। আর যাঁরা তাকান কিন্তু দেখতে পান না, দেখতে চান না, তাঁরা শ্বেতান্ধ, মতান্ধ, স্বার্থান্ধ।
রেটিনা বা লেন্সের ব্যর্থতার জন্য এই অন্ধত্ব আসে না। এই অন্ধত্ব আসে মানুষকে মানুষ মনে না করা থেকে, ক্ষমতার ঘোড়ার চোখে ঠুলি পরালে। এই অন্ধত্ব আসে ক্রমাগত মিথ্যা বলে যেতে থাকলে। সারামাগোর সেই অন্ধ শহরটা একদিন আবার দৃষ্টি ফিরে পেয়েছিল। যখন অন্ধ হানাহানির নরকে আবার ভালোবাসা ও মানবিকতা ফিরে এসেছিল।
অন্ধদের কাছে আয়নার কোনো গুরুত্ব নেই, কিন্তু যাঁরা এখনো দেখতে চান তাঁরা আয়নায় স্বদেশের মুখটা দেখুন। তা কি শাদা ব্যান্ডেজে চোখ বাঁধা সিদ্দিকুরের মতো নয়?