২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মের আদিবাসী ও বাঙালিদের ওপর রংপুর মহিমাগঞ্জ চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের হামলা, লুটপাট, খুন, উচ্ছেদ, অগ্নিসংযোগ ও হয়রানির ঘটনার পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও নিপীড়িত মানুষেরা প্রকৃত বিচার পায়নি। উপরন্তু পুলিশ ব্যুরো ও সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন থেকে বাদ পড়েছে মামলার প্রধান আসামি সাবেক সাংসদ আবুল কালাম আজাদ এবং সাঁওতালদের বাড়িতে আগুন দেওয়া পুলিশ সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম।
এর ভেতরেই গত ২৪ আগস্ট গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের (বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি, সংক্ষেপে বেপজা) বর্তমান নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল নজরুল ইসলাম সাহেবগঞ্জ–বাগদা ফার্মের ১ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমিতে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ইপিজেড চালু করার কথা ঘোষণা করেছেন।
যেকোনো এলাকা উন্নয়নের জন্য ইপিজেড স্থাপন সে এলাকার মানুষের জন্য অবশ্যই সুখের খবর। কিন্তু সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মের আদিবাসী ও বাঙালিদের জন্য তা সুখের খবর নয়। কারণ, ওই জমির ওয়ারিশদের কোনো ধরনের পূর্বাবহিত সম্মতি ছাড়াই ইপিজেড স্থাপনের ঘোষণা এসেছে।
এটি আদিবাসী-বাঙালি জনগণকে আরও হতাশ করেছে।সাঁওতালদের রক্তে ভেজা তিন ফসলি জমিতে ইপিজেড নির্মাণের বিরুদ্ধে এখনো জাগ্রত আছে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম। এই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে বহু সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, পরিবেশবাদী সংগঠন, ব্যক্তি, অ্যাকটিভিস্ট, লেখক, গবেষক, মানবাধিকারকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষক, পেশাজীবী, আদিবাসী সংগঠকসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানার সাপমারা ইউনিয়নের রামপুর, সাপমারা, মাদারপুর, নারেংগাবাদ ও চকরাহিমপুর মৌজার ১ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৫৪-৫৫ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার রংপুর (মহিমাগঞ্জ) চিনিকলের আখ ফার্ম করার জন্য অধিগ্রহণ করেন।
তৎকালীন সরকার জোরজুলুম ও নানা ছলনার মাধ্যমে অধিগ্রহণ করলেও চিনিকলের স্বার্থে ১৫টি আদিবাসী সাঁওতাল গ্রাম ও ৬টি বাঙালি গ্রামের প্রায় ২ হাজার ৫০০ পরিবারের সদস্যরা চিনিকলের স্বার্থে বাপ–দাদার ভিটা-জমি-বাড়ি-ঘর ছেড়ে যান। উচ্ছেদের ফলে আদিবাসীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন এবং মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হন।
২০০৪ সালে রংপুর চিনিকল বন্ধ ঘোষণা করা হলে মিল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাঝে সাহেবগঞ্জ–বাগদা ফার্ম এলাকার ১ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি অবৈধভাবে লিজ প্রদান করতে থাকে। ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই তারিখের চুক্তিপত্রের (মেমোরেন্ডাম) ৫ নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে যে ১ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর সম্পত্তি রংপুর চিনিকলের আখ ফার্ম করার জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
ওই সম্পত্তিতে আখচাষের পরিবর্তে যদি কখনো অন্য ফসল উৎপাদিত হয় তাহলে অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন সরকার বরাবর ফেরত (সারেন্ডার) প্রদান করবে। সরকার ওই সম্পত্তি গ্রহণ করে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে, মানে জমির মালিকদের (উত্তরাধিকারসূত্রে যাঁরা এখন জমির ওয়ারিশ) জমি ফিরিয়ে দেবে।
আখচাষ ও মিল বন্ধ হওয়ার ফলে সাহেবগঞ্জ–বাগদা ফার্ম এলাকার উত্তরাধিকারীদের জমি পৈতৃকসূত্রে ফেরত পাওয়ার অধিকার তৈরি হলে আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ পৈতৃক ভিটায় চলে আসে এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সবস্তরের মানুষের মতামত নিয়ে পৈতৃক সম্পত্তি ফেরতের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। সে সময় চিনিকল কর্তৃপক্ষ আদিবাসী সাঁওতাল ও বাঙালিদের জুলুম নির্যাতন–নিপীড়নসহ তাঁদের বিরুদ্ধে কয়েকটি মিথ্যা মামলা করে।
৬ নভেম্বর ২০১৬ মিল কর্তৃপক্ষ বেআইনিভাবে (কোর্টের আদেশ ব্যতীত) ৫০০–র বেশি পুলিশ, র্যাব, রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভাড়া করা সন্ত্রাসীরা উচ্ছেদের নামে নিরীহ আদিবাসীদের ওপর হামলা, বসতবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং বর্বরোচিতভাবে গুলিবর্ষণ করে।
হামলায় শহীদ হন শ্যামল হেমরম (৩৫), মঙ্গল মার্ডি (৫০) ও রমেশ টুড (৪০) নামের তিন সাঁওতাল কৃষক। হামলার রাতেই দ্বিজেন টুডু, চরন সরেন ও বিমল কিস্কুকে জখম অবস্থায় পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ওই ঘটনায় এক হাজার ২০০–এর বেশি পরিবার উচ্ছেদের শিকার হয়। গোবিন্দগঞ্জ পুলিশ প্রশাসন ঘটনার পরেই আদিবাসীদের বিরুদ্ধে দুটি মিথ্যা মামলা করে। এ দুটি মামলায় ৪২ গ্রামবাসী এবং অজ্ঞাতনামা ৪০০ জনকে আসামি করা হয়। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনে মামলার প্রধান আসামি সাবেক সাংসদ আবুল কালাম আজাদ, অগ্নিসংযোগকারী পুলিশ সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের নাম বাদ পড়ে।
বেপজার পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, ইপিজেড স্থাপন হলে দুই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু ১৯৬২ সালে বেশির ভাগ সাঁওতালদের জমি অধিগ্রহণ করে সাহেবগঞ্জ–বাগদা ফার্মে রংপুর (মহিমাগঞ্জ) চিনিকল স্থাপন করা হয়েছিল। ১৯৬২ থেকে ২০২১, এই ৫৯ বছরে ১৫টি গ্রামের মাত্র দুজন সাঁওতাল সেখানে কেয়ারটেকার ও ড্রাইভারের চাকরি পেয়েছিলেন। বাগদা ফার্ম-সাহেবগঞ্জের ভূমিহীন মানুষ তাই বিশ্বাস করতে পারছেন না, ইপিজেড হলে তাঁদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে।
শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং ইপিজেড নির্মাণ একটি দেশের উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু যে জমিতে ইপিজেড নির্মাণের কথা উঠেছে, তার এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে, এখানকার মানুষ দীর্ঘ বিচারহীনতার ভেতর আছে। চিনিকলের নামে বর্ণবাদী পাকিস্তান সরকার যেভাবে তাঁদের জমি কেড়ে নিয়েছিল, আজ স্বাধীন বাংলাদেশ সেই নিপীড়িত মানুষদের আর নির্যাতনের শিকলে বন্দী রাখতে পারে না। বঙ্গবন্ধু চিরকাল মেহনতি, মজদুর, শ্রমিক, কৃষকের মুক্তি চেয়েছেন, জনগণের জন্য ন্যায্য ও সমতার বাংলাদেশ নির্মাণ করতে চেয়েছেন। সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মের আন্দোলনকারী সাঁওতাল-বাঙালিরা কৃষক। করোনাকালেও যখন দেশ-দুনিয়া বিধিনিষেধে ছিল, তখনো এই বাগদা ফার্ম-সাহেবগঞ্জের সাঁওতাল-বাঙালিরা দিনরাত পরিশ্রম করে ফসল ফলিয়েছেন, সমুন্নত রেখেছেন বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা, সচল থেকেছে গ্রামীণ অর্থনীতি। ১৮৪২.৩০ একর জমিতে আমন ও বোরো মৌসুমে দান ফলে, ফলে বহু রকমের রবিশস্য।
তিন ফসলি এমন জমিকে বিনষ্ট করে দেশের খাদ্যনিরাপত্তাকে বিপদের মুখে ফেলে কেউ এমন জমিতে ইপিজেড করতে চাইবে না।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বহু বক্তৃতা ও আলোচনায় তিন ফসলি জমিকে রক্ষার দাবি জানিয়েছেন, কোনোভাবেই তিন ফসলি জমি নষ্ট করে শিল্পায়ন না করার কথা বলেছেন। কৃষিজমি সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর এই সাহসী উচ্চারণের সঙ্গে একাত্ম হয়েই আন্দোলনকারীরা রক্তভেজা তিন ফসলি জমিতে ইপিজেড নির্মাণের বিরোধিতা করছেন।
প্রস্তাবিত কৃষিজমি সুরক্ষা আইন (২০১৫), জাতীয় কৃষিনীতি, অধিগ্রহণ আইন এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন সব সময় তিন ফসলি জমি ও বিশেষ বাস্তুসংস্থান সুরক্ষার কথা বলেছে। পাশাপাশি গাইবান্ধার সাঁকোয়াতে এক ফসলি জমিতে ইপিজেড নির্মাণের দাবিতে সম্মতি দিয়েছেন স্থানীয় জনগণ। আমরা আশা করব, রাষ্ট্র সংবিধান ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে সাঁওতালদের রক্তভেজা তিন ফসলি জমি সুরক্ষায় এগিয়ে আসবে।
লেখকেরা রাজনীতিক, মানবাধিকারকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক, পরিবেশকর্মী এবং সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত গবেষক-লেখক-সংগঠক।