‘স্বাধীনতা পদক’ শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে একটি গৌরব ও ভক্তির ভাব। গৌরব কারণ, স্বাধীনতা বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন। ভক্তি কারণ, এত বড় গৌরব যিনি অর্জন করেছেন, তাঁকে দেশের সবাই মিলে মাথা নুইয়ে প্রণতি জানাবে। কিন্তু এমন সম্মান যদি চলে যায় হীনপাত্রে বা অপাত্রে, তখন অপমান করা হয় দেশের স্বাধীনতাকেই, অপমান করা হয় লাখো শহীদকে। জাতীয় সম্মান যখন অপাত্রে দান করা হয়, তখন দেশের মানুষ ভীষণ রকম আশাহত হয়, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কর্মস্পৃহা ধ্বংস হয়, কঠিন সাধনার মধ্য দিয়ে সৃষ্টির পরাকাষ্ঠায় পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষা থেমে যায়। সর্বোপরি, এভাবে প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটে, যুগের পর যুগ দেশ সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়। রাষ্ট্রীয় এমন সব কাণ্ডকারখানা মানুষের ওপর প্রবল স্নায়বিক চাপ সৃষ্টি করে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তাঁরা মানসিক রোগীতেও পরিণত হতে পারে, যা জাতীয় সম্পদের এক নির্মম অপচয়।
এ বছর সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্তের তালিকায় আমির হামজার নাম ঘোষণা করা হয়। এ বিষয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠায় তাঁর নাম প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। সাহিত্যমহলে একদম অপরিচিত একজনের নাম ঘোষণা করায় মানুষ এতই হতবাক যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা করতেই সবাই ভুলে গেছে। প্রশ্নটা হলো আমলাদের অসীম ক্ষমতাবিষয়ক। প্রথম কথা হলো, একজন সচিবের যে কারও নাম প্রস্তাব করার ক্ষমতা। সচিবদের এমন ক্ষমতা দেওয়ার কারণটা কেউ কি আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবেন? অবদান পরিমাপ করার মতো যোগ্যতা, সময়, অনুসন্ধিৎসা, ধৈর্য, পরিশ্রম করার ইচ্ছে কি সচিবদের থাকে? সাহিত্যের কথা ধরি, সাহিত্য বিচার তো একটি দুরূহ কাজ। প্রথমত, সারা জীবন ধরে নিজের ব্যাপক পড়াশোনা থাকতে হয়। দ্বিতীয়ত, সমালোচনা সাহিত্যে তাঁকে বিশেষজ্ঞ হতে হবে, যার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি দরকার সাহিত্য সমালোচনার দীর্ঘকালের অনুশীলন।
জানা গেছে, আমির হামজার নাম প্রস্তাব করেছিলেন বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ। এর আগে ২০২০ সালে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য নাম ঘোষিত হয়েছিল এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদের। তাঁর নামের প্রস্তাব এসেছিল কোনো সচিবের কাছ থেকে। এসব নাম প্রস্তাবের বিনিময়ে তাঁরা কী নিয়েছেন, তার কি কোনো তদন্ত হয়েছে?
বাঙালির চাটুকারিতাকে উপজীব্য করে প্রচুর সাহিত্য রচিত হয়েছে, চলচ্চিত্র, নাটক নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ প্রবন্ধটিই শ্রেষ্ঠ। এখানে তিনি ‘শিখিয়েছেন’ কাকে, কীভাবে, কোন মুহূর্তে, কী পরিমাণ তৈল প্রদান করতে হবে। আমলাদের ‘স্যার’ বলা সেই চাটুকারিতারই একটি প্রকাশমাত্র।
আমলা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই সামান্য। আসুন কিছু উদাহরণ সহকারে ‘আমলা’ জিনিসটা বোঝার চেষ্টা করি। মনমোহন সিং সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদে থাকাকালে ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক কৌশিক বসু স্মৃতিকথা-সংবলিত গ্রন্থ ‘পলিসিমেকারস জার্নাল: ফ্রম নিউ দিল্লি টু ওয়াশিংটন ডিসি’-তে বেশ কিছু মজার ঘটনা উল্লেখ করেন বিশেষ করে, আমলাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে। উন্নয়ন অর্থনীতিতে ইনস্টিটিউশন, গভর্ন্যান্স ও ব্যুরোক্রেসি ইত্যাদির ওপর বিস্তর আলোচনা হয়, কারণ এগুলো উন্নয়নের একেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ভারতের আমলাদের বুঝতে চেয়েছেন গভীরভাবে। আক্ষরিক অর্থেই তিনি একদিন গুনে গুনে হিসাব করে দেখেছেন যে একজন আমলা তাঁর ঊর্ধ্বতনকে মিনিটে ১৬ বার ‘স্যার’ বলেন।
কৌশিক বসুর মতো অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে ‘আমলা’ বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছি আমিও। আমার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি ও দুর্নীতি’। বাথ ইউনিভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়ে একটানা দেড় বছর বাংলাদেশে অবস্থান করে নিজে উপাত্ত সংগ্রহ করেছি, অসংখ্য মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি শুধু আমলাদের দুর্নীতি বিষয়ে জ্ঞানলাভের জন্য। আমি একবার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম এক পুলিশ সুপারের বাসায়। তিনি তখন গাজীপুরে। বাসায় ঢোকার আগে থেকেই তিনি গাজীপুরের সাংসদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছিলেন। নিজের প্রতিটি বাক্যের আগে ও পরে এবং সাংসদের প্রতিটি বাক্যের শেষে তিনি ‘স্যার’ বলছিলেন। এভাবে আধা ঘণ্টা চলেছিল সেই কথোপকথন। ব্রিটিশ কলোনি হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারত একই আইনের উত্তরাধিকার। অতএব কৌশিক বসুর পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমার পর্যবেক্ষণ মিলে যাবে—সেটাই তো স্বাভাবিক। বাথ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জিওফ উড ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি কয়েকটা ঘটনার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে সব শেষে বললেন, ‘আমার উপস্থিতিতেই একটি কাজ পেতে একটি বিদেশি কোম্পানির প্রতিনিধি সচিবকে ঘুষ সাধলেন।’
অভিসন্দর্ভের আরও কিছু দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করা যাক। ১. এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান বলেছিলেন, ‘লাইনম্যানরা আমার বাড়ির টেলিফোন লাইনও কেটে দেয়। তারপর ঘুষ দিয়ে আবার চালু করতে হয়।’ উল্লেখ্য, এই ঘুষের টাকা অফিসের বড় কর্তা পর্যন্ত ভাগ হয়ে যায়—একাধিক লাইনম্যানের সঙ্গে কথা বলে এটা জেনেছি। ২. বিএনপির আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমলাদের দুর্নীতি-সংক্রান্ত এক আইন খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর আমাকে না জানিয়ে আমলারা শব্দবিন্যাস পরিবর্তন করে তাঁদের অনুকূলে নিয়ে যান এবং এভাবেই আইনটি সংসদে পাস হয়ে যায়।’
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জেনারেল এরশাদ বলেছিলেন, ‘আমলারাই আমাকে ডুবিয়েছে। আমলাদের কারণেই উন্নয়নমূলক কাজগুলো করা সম্ভব হয়নি।’ কারাগারে থাকার সময় কারারুদ্ধ আরেক আমলাকে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। তিনি আমলাদের প্রতি এতই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে সেই আমলাকে তাঁর কক্ষ থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখের খবর, ‘চিনিকল বন্ধের পর বেকার হয়ে পড়া শ্রমিকের পুনরায় কর্মসংস্থানের বিষয়ে নিজের হতাশার কথা জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বিকল্প কর্মসংস্থান না হওয়ার পেছনে তিনি দুষেছেন সরকারের আমলাতন্ত্রের দীর্ঘসূত্রতাকে।’
নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটিতে যাঁদের নামের প্রস্তাব এসেছে, তার অধিকাংশই আমলা। দুদকের চেয়ারম্যান সব সময় আমলা। এ পর্যন্ত যত নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, তার সদস্যের প্রায় সবাই সামরিক বা বেসামরিক আমলা। সর্বত্র আমলা। প্রশ্ন উঠবে, আমলা নিয়োগে সমস্যা কী? হ্যাঁ, এই সমস্যাটাই আমাদের বোঝার চেষ্টা করা দরকার। ওপরে ইতিমধ্যেই অনেক আলোচনা হয়েছে। স্বাধীনতা পদকের জন্য নাম প্রস্তাবের ক্ষমতা সচিবদের দেওয়ার আইন আমলারাই করেছেন। হয়তো বলবেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী তো সেখানে ছিলেন। কিন্তু মন্ত্রী যদি অযোগ্য হন, আমলারাই সব সময় মন্ত্রীর ওপর ছড়ি ঘোরায়।
আমলা নিয়োগে সমস্যার একটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দরকার। আমলারা যে বারবার ‘স্যার’ বলেন, এটা হলো চাটুকারিতার লক্ষণ। যখন যে দল ক্ষমতায় যায়, সেই সরকারের একটি বশংবদ যন্ত্রে পরিণত হতে হয় তাঁকে, রাষ্ট্রের কাজেও দলীয় নীতি মেনে চলতে হয়। না হলে তাঁর প্রমোশন হবে না, ঘুষ খেলে শাস্তি এড়াতে পারবেন না। সরকারের নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে সমগ্র চাকরিজীবন অতিবাহিত হওয়ার কারণে তাঁদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা লোপ পায়, ‘আউট অব দ্য বক্স’ তথা ভিন্নভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা গড়ে ওঠে না। দীর্ঘকাল দুর্নীতির পরিবেশে থেকে স্রোতে বিপরীতে গিয়ে দেশের স্বার্থে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করার মতো সামান্য বৈপ্লবিক কাজ করাও তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে সাবেক আমলা নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রশ্ন হলো, তাঁরা কি দুর্নীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, এ বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান কি তাঁদের আছে? অর্থাৎ দুর্নীতি কেন হয়, এর কারণ ও সমাধান বিষয়ে তাঁদের কি পড়াশোনা ও গবেষণা আছে? তাঁদের কর্মজীবন কি স্বচ্ছ ছিল? তাঁরা কি দুর্নীতির বাইরে থাকতে পেরেছিলেন? সম্পদের পরিমাণ, সম্পদ ও আয়ের উৎস সম্পর্কে যথার্থ ব্যাখ্যা দিতে পেরেছিলেন? দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে এসব প্রশ্ন করার অধিকার আমাদের আছে। নির্বাচন কমিশন গঠন প্রসঙ্গেও আমাদের একই প্রশ্ন।
দুর্নীতি বিষয়ে এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বে পণ্ডিত, গবেষক, শিক্ষাবিদ বা লেখক এবং একই সঙ্গে সর্বজন গ্রাহ্য এমন ব্যক্তির কি আকাল পড়েছে বাংলাদেশে? সর্বত্র সামরিক বা বেসামরিক আমলা নিয়োগ করতে হবে কেন? সরকারের দলীয় উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই দীর্ঘকাল বশংবদ হিসেবে কাজ করার অভ্যাস গড়ে তুলেছেন—এমন ব্যক্তিদেরই তাঁরা নিয়োগ দেন। এ ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে?
বাঙালির চাটুকারিতাকে উপজীব্য করে প্রচুর সাহিত্য রচিত হয়েছে, চলচ্চিত্র, নাটক নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ প্রবন্ধটিই শ্রেষ্ঠ। এখানে তিনি ‘শিখিয়েছেন’ কাকে, কীভাবে, কোন মুহূর্তে, কী পরিমাণ তৈল প্রদান করতে হবে। আমলাদের ‘স্যার’ বলা সেই চাটুকারিতারই একটি প্রকাশমাত্র। শুনেছি, দেশে নতুন রেওয়াজ চালু হয়েছে। তা হলো, সচিবদের স্ত্রীদের ‘মিসেস সেক্রেটারি’ বলা। আসলে, বাংলাদেশের রাজনীতি ও আমলাদের চরিত্র বুঝতে হলে আপনাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ প্রবন্ধটি ও আব্দুল গণি হাজারির ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’ কবিতাটি পড়তেই হবে। না হলে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয় দুটির আগামাথা আপনারা কিছুই বুঝবেন না—এ আমি হলফ করে বলতে পারি।
এন এন তরুণ, রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@gmail. com