সবকিছু কবে আবার আগের মতো হবে

ধারণা করা হয়েছিল, ২০১৯ সালে শুরু হওয়া ঘাতক ব্যাধি নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ সহসাই কেটে যাবে। জীবনযাত্রা আবার আগের মতো ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠবে। আক্রান্ত হওয়া ও প্রাণহানির হার খানিকটা কমলেও এখনো একেবারে তা বন্ধ হয়নি। তথাপি রাজনীতিবিদেরা বলছেন সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখা যাচ্ছে। যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তাঁদের দেশের আগামী স্বাধীনতা দিবসের (৪ জুলাই) আগেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এ আশাবাদের কারণ হলো অনেক টিকা বাজারে আসা এবং এর ব্যাপক প্রয়োগ। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে যে দিল্লি হনুজ দূর অস্ত। সিঙ্গাপুরের মতো মুক্ত দেশেও এখনো বিমান চলাচল উন্মুক্ত করা হয়নি। সে দেশে টেস্ট, টিকা গ্রহণ নির্বিশেষে সব বহিরাগতর জন্য ১৪ দিনের সঙ্গনিরোধের আদেশ এখনো বলবৎ আছে।

কেবল আমাদের দেশেই নয়, যেখানেই করোনার প্রকোপ কমেছে ভেবে জীবনযাত্রার ওপর বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে, সেখানেই করোনা আবার হানা দিয়েছে। আবার সঙ্গনিরোধ ব্যবস্থা আরোপ করা হয়েছে। ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি কেউ এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশসহ ইউরোপের অনেক দেশেই আবার করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু বেড়েছে। একে কেউ কেউ করোনার তৃতীয় ঢেউ বলে অভিহিত করেছেন।

টিকা নিয়ে যে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল, তাতেও খানিকটা ভাটা পড়েছে। টিকা নেওয়ার পরও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, এমনকি মৃত্যুবরণও করছেন। বাংলাদেশে একজন সাংসদের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। এর মধ্যেই যোগ হয়েছে টিকা রাজনীতি। আবিষ্কারক কোম্পানি ও দেশের ব্যবসায়িক স্বার্থ একাকার হয়ে গেছে।

টিকার কার্যকারিতা ও এর প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগ–পরবর্তী রক্ত জমাট বঁাধা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিসহ বিশ্বের ১৫টি দেশে এর ব্যবহার স্থগিত রাখা হয়েছে। যুক্তরাজ্য সরকার ও টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানি অবশ্য দাবি করেছে যে রক্ত জমাট বঁাধার সঙ্গে তাদের টিকার কোনো সম্পর্ক নেই। এ পরিস্থিতিতে এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও রেফারির ভূমিকায় হিমশিম খাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কোনো কোনো দেশে টিকার এখনো একেবারেই পৌঁছায়নি। আবার কোনো কোনো দেশে কেবল এক ধরনের টিকা ব্যবহৃত হচ্ছে। সব মিলিয়ে এখন এমন একটা অবস্থা যে সবকিছু কবে আবার আগের মতো হবে কিংবা আদৌ হবে কি না, কেউ এটা হলফ করে বলতে পারছেন না।

বৈষম্যের ভাইরাস

আন্তর্জাতিক মানবসেবা সংগঠন অক্সফামের ‘বৈষম্যের ভাইরাস’ শীর্ষক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, অতিমারি ব্যবসার ভালো সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ফলে করোনাকালে ধনকুবেরেরা আরও ধনী হয়েছেন। এ সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১০ ব্যক্তির সম্পদের মোট পরিমাণ বেড়েছে ৫৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যেমন ২০২০ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারতের গৌতম আদানির সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৩০ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ধনীর অসুখ

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ঢাকার কড়াইল বস্তিতে করোনায় আক্রান্তের হার মাত্র ৬ শতাংশ। অথচ সেখানে প্রতি ১০০ জন বাসিন্দার জন্য দুটি শৌচাগার আছে। বাসিন্দাদের কেউ মাস্ক পরেন না। দেখা গেছে যঁারা শার্ট, জুতা পরিধান করেন না এবং সূর্যালোক ও খোলা প্রকৃতিতে বিচরণ করেন, তঁাদের অধিকতর রোগ অনাক্রম্যতা রয়েছে। যাঁরা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে থাকেন, সূর্যালোকের সংস্পর্শে আসেন না এবং কৃত্রিম উপায়ে রক্ষিত খাবার খান, তাঁদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্ক বেশি। তাই অনেকে একে ধনীর অসুখ বলে বর্ণনা করেছেন।

দারিদ্র্যের প্রবৃদ্ধি

ব্র্যাকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে করোনায় চরম দারিদ্র্য ৬০ শতাংশ বেড়েছে। করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের নিম্নবিত্তের আয় ৭৫ ভাগ কমেছে, চরম দারিদ্র্যের সংখ্যা ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই জরিপ অনুযায়ী, তাঁদের ৭২ শতাংশের কাজ কমে গেছে, নয়তো তঁারা আয়ের সুযোগ হারিয়েছেন। ৮ ভাগের কাজ থাকলেও মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। জরিপ চলাকালে ১৪ ভাগ মানুষের ঘরে কোনো খাবার ছিল না এবং ২৯ ভাগের ঘরে ছিল এক থেকে তিন দিনের খাবার। সরকারের জরুরি ত্রাণ পৌঁছেছে মাত্র ৪ শতাংশ মানুষের কাছে।

প্রকৃতির প্রতিশোধ

কেউ কেউ বলছেন, ভাইরাসটি প্রকৃতির প্রতিশোধমাত্র। বিশ্বব্যাপী অটেকসই জীবনযাপন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, অনাচারকে এ জন্য দায়ী করেছেন। তাই এ সমস্যাগুলোর সমাধান না করে কেবল প্রতিষেধক টিকা ও আক্রান্তের চিকিৎসা করে এ সমস্যার সমাধান হবে এবং মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে, তা মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে সামাজিক চিকিৎসার প্রয়োজন হবে।

নতুন স্বাভাবিক

তাই আমাদের ‘আগের মতো’ অবস্থায় ফিরে যাওয়ার কথা না ভেবে ‘নতুন স্বাভাবিকে’ ফিরে যেতে হবে। যার মূল ভিত্তি হবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ। যা কিছু অপ্রয়োজনীয়, তা জীবন থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে। অনাবশ্যক শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার, কৃত্রিম উপায়ে রক্ষিত খাবার গ্রহণ ও পর্যটন পরিহার করতে হবে এবং সামাজিক সম্পদের পরিমিত ও সুষম ব্যবহার করতে হবে। ধরিত্রী কেবল আমাদের—এ ধারণা থেকে সরে এসে পাখপাখালি, জীবজন্তু, সরীসৃপ সবার সঙ্গে সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করতে হবে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনের পরিবর্তে আগের মতো বৃহত্তর পরিবার ও যূথবদ্ধ জীবনে ফিরে যেতে হবে। কড়াইল বস্তির রোগ প্রতিরোধক্ষমতা থেকে শিক্ষা এটাই। হালে একটা কথা চালু হয়েছে ‘শহরের সুবিধা গ্রামে’ তার পাশাপাশি ‘গ্রামের সুবিধা শহরে’ এ নীতি অনুসরণ করতে হবে। এর মধ্যেই কেউ কেউ তা শুরু করে দিয়েছেন। নগরজীবনে ছাদকৃষি এসবের সূচনামাত্র। এ জন্য স্থপতি, নগর-পরিকল্পনা ও প্রযুক্তিবিদদের একযোগে কাজ করতে হবে।

শেষ করি লিও তলস্তয়ের ‘একজন মানুষের কতখানি জমি প্রয়োজন’ ছোটগল্প দিয়ে। গল্পের শুরু ‘নগরজীবন না গ্রামীণ জীবন ভালো’ এ নিয়ে দুই বোনের বিতর্ক নিয়ে। গল্পের নায়ক ছোট বোনের স্বামী, গল্পের নায়ক কৃষক পাহম বলে ওঠে সে গ্রামে সম্পূর্ণ সুখী। তবে আরও বেশি জমি পেলে সে শয়তানকেও পরোয়া করত না। আড়ি পেতে থাকা শয়তান তা শুনে পাহমের জীবন ধ্বংস করার পরিকল্পনা আঁটে। শয়তানের পরিকল্পনা অনুযায়ী পাহম ছলে–বলে–কৌশলে টাকা কামাই ও আরও জমি আয়ত্ত করার নেশায় মেতে ওঠে।

এ সময় পাহম দূরবর্তী বাশকির সম্প্রদায়ের অনেক উর্বর জমির খবর পায়। বাশকিররা অল্পে তুষ্ট। তাই সামান্য পরিশ্রমে যা খাবার উৎপাদিত হয়, তা নিয়ে তারা অনায়াসে হেলেখেলে জীবন কাটায়। ফলে অনেক জমিই অনাবাদি পড়ে থাকে। পাহম বাশকির উপহার দেয়। বাশকিররা এক হাজার রুবলের বিনিময়ে পাহমের কাছে জমি বিক্রয়ে সম্মত হয়। তারা বলে, পাহম এক দিনে যতটা জমি প্রদক্ষিণ করতে পারে, সে পরিমাণ জমির সবটুকুই তার হবে। সূর্যোদয় হতেই পাহম বের হয়ে পড়ে। যাতে করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জমি দখলে নিতে পারে। এ জন্য সে মাঝেমধ্যে শাবল দিয়ে তার যাত্রাপথ চিহ্নিত করতে থাকে। সূর্যাস্ত ঘনিয়ে এলে সে তখন ও যাত্রা শুরুর জায়গা থেকে বেশ খানিকটা দূরে। যাত্রার ক্লান্তি সত্ত্বেও সে দৌড়াতে থাকে। কেননা, বাশকিরদের দেওয়া শর্তানুযায়ী আগের জায়গায় ফিরতে না পারলে সে কোনো জমিই পাবে না। সে নির্ধারিত সময়ে শুরুর জায়গায় পৌঁছে ঠিকই, কিন্তু তখনই ক্লান্তিতে মারা যায়। পাহমের একজন ভৃত্য তাকে ছয় ফুট লম্বা কবরে সমাহিত করে।

আমাদের বর্তমান ‘পাহম জীবনযাত্রায়’ পরিবর্তন আনতে হবে। না হলে বর্তমান সংকট থেকে উদ্ধার পেলেও আবার সংকটে নিপতিত হতে হবে।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ