সাম্প্রতিক এক আদেশে সরকার অটিস্টিকদের জন্য গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে। এ জন্য সঞ্চয়পত্র বিধি, ১৯৭৭ (সংশোধিত ২০১৫) সংশোধন করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) গত ২৫ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এত দিন কোনো প্রতিষ্ঠান এ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারত না। সে হিসেবে অটিস্টিকদের জন্য কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোই প্রথম সুযোগ পাচ্ছে। এ জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব আমাদের ধন্যবাদ পেতে পারেন।
দাতা বা উদ্যোক্তার উৎসাহে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ ব্যয় জোগাড় হলেও নিত্যদিন এর পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রাথমিকভাবে জনকল্যাণমূলক প্রকল্প সম্পর্কে উৎসাহ থাকলেও অনতিবিলম্বে দাতাদের মধ্যে একধরনের অবসাদ দেখা দেয়, ফলে নিয়মিত চাঁদা থেকে পরিচালন ব্যয় নির্বাহ কঠিন হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠানের আয় নেই বা পরিচালন ব্যয়ের তুলনায় আয় অতি সামান্য, তাদের পরিচালনা রীতিমতো দুরূহ হয়। তা ছাড়া ঐতিহ্যগতভাবেও আমরা প্রচারহীন দানশীলতার জন্য পরিচিত নই। ফলে অনেক ভালো প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগ কয়েক বছর পর বন্ধ হয়ে যায়।
এসব ক্ষেত্রে একমাত্র বিকল্প হলো একটি নিরাপদ বিনিয়োগ, যা থেকে পরিচালন ব্যয় নির্বাহের জন্য নিয়মিত আয় পাওয়া যাবে। অন্যান্য দেশে পুঁজিবাজারে শেয়ার বা বন্ডে বিনিয়োগ করে এ ধরনের নিরাপদ ও নিয়মিত আয় করা সম্ভব। আমাদের দেশে একমাত্র উপায় ছিল ব্যাংকে মেয়াদি বিনিয়োগ। কিন্তু বর্তমানে মেয়াদি আমানতের সুদের হার যেভাবে কমানো হয়েছে, তাতে আয় তো দূরের কথা, আসল বিনিয়োগই কমে যায়। বর্তমানে মেয়াদি বিনিয়োগের সুদের হার ৫ শতাংশ, যা মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম। পরিচালন ব্যয় ছাড়াও এসব প্রতিষ্ঠানকে কয়েক বছর পরপর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করতে হয়। এ জন্যই আইআরডির সিদ্ধান্তটি সময়োচিত।
সব ট্রাস্ট ট্রাস্ট নয়
এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো প্রদত্ত সুবিধার অপব্যবহার। তা কর অব্যাহতি কিংবা সঞ্চয়ের সুযোগ যেটাই হোক না কেন। বণিক বার্তার এক সংবাদে বলা হয়েছে, একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিরা এক বছরে শুধু ভাতাই নিয়েছেন ৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া সংবাদে ট্রাস্টিদের সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ব্যবসায়িক সুবিধা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। অথচ ট্রাস্টিদের বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকা দেওয়ার কথা, নেওয়ার নয়। উদাহরণস্বরূপ, বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের প্রয়াত চেয়ারম্যান আর্থার জে বি মেটকাফের কথা মনে পড়ছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান ও প্রকৌশল কেন্দ্রের জন্য অনেক মিলিয়ন মার্কিন ডলার দান করেন। শুধু কি দানের হাত, মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। আমি তখন সেখানে টিচিং ফেলো, অর্থাৎ আমি নিজে ছাত্র এবং প্রথম বর্ষের ছাত্রদের অর্থনীতির মূলনীতি কোর্স পড়াই। একদিন ফ্যাকাল্টি ক্যাফেটেরিয়ায় দেখি খাবারের লাইনের বেশ পেছনে তিনি প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। কেবল ছবি দেখেছি। আমি বিনয় করে বললাম, আমি লাইনে সামনে আছি, তুমি চাইলে আমরা জায়গা অদলবদল করতে পারি। তিনি রাগের ভান করে চোখ টিপে আমাকে বললেন, তুমি দেখছ না, আমি আমার সামনের সুন্দরী মহিলাদের দেখতে দেখতে কেমন সুন্দর এগিয়ে যাচ্ছি! এখানেই শেষ নয়, খাবার হাতে নিয়ে আমার টেবিলে এসে আমাকে লাইনে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে গেলেন। উল্লেখ্য, অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক শিক্ষানুরাগী আর্থার মেটকাফ হার্ভার্ড ও এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী ছিলেন।
এর বিপরীতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা বলি। ক্লাস নিয়ে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ দেখি প্রহরীরা ছোটাছুটি করছে, হুইসেল বাজাচ্ছে। তাদের বুটের শব্দ ও হইচইয়ে আমি ভাবলাম হয়তো মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে। না, পরে দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সভা শেষে ট্রাস্টিরা ফিরে যাচ্ছেন। তাঁদের বিদায় জানাতেই এমন শোরগোল। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের জন্য আছে আলাদা লিফট!
বাংলাদেশেও সব ট্রাস্ট বা সোসাইটি এমন নয়।ঢাকার বাইরে সিরাজগঞ্জের নিভৃত পল্লি এনায়েতপুরে স্থাপিত খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের সংঘ স্মারকে বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের আয়, তা যেভাবেই হোক না কেন, তা সমিতির সদস্যদের মধ্যে ডিভিডেন্ড, বোনাস বা অন্য কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। এমনকি সোসাইটি বিলুপ্ত হলেও এর দায়দেনা মিটিয়ে এর সম্পদ অনুরূপ সেবামূলক কাজে ব্যবহার করতে হবে এবং কোনোভাবেই সমিতির সদস্যদের দেওয়া যাবে না। উপরন্তু, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সমিতির সদস্যরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অনেক টাকা দান করে আসছেন।
আয়কর, ট্রাস্ট, সমিতি আইন ও বিধি সংশোধন
আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়িক স্বার্থে ও কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে ট্রাস্ট ও সমিতি গঠন করা হয়। এখানে মূল বিবেচ্য বিষয় হলো, ট্রাস্ট ও সমিতির সদস্য, ট্রাস্টি বা তাঁদের আত্মীয়-পরিজনেরা প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন কি না। যেসব প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তিগত আয় বা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে, সেগুলোকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এদের আয়কর অব্যাহতির আওতার বাইরে রাখতে হবে এবং সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুবিধা প্রদান করা যাবে না। উদাহরণস্বরূপ, উল্লিখিত বিশ্ববিদ্যালয় ও খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে হবে। এ জন্য আয়কর, ট্রাস্ট ও সমিতি আইন ও বিধিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুযোগ
আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে অটিজম নিয়ে কাজ করা ছাড়াও অন্যান্য দাতব্য কাজের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান, যেখানে উদ্যোক্তা বা তাদের আত্মীয়-পরিজনদের আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানকেও সরকারি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। এ সুবিধার অপব্যবহার রোধ করার জন্য এ শর্তগুলো আরোপ করা যেতে পারে:
এক. প্রতিষ্ঠানটি রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অথবা সমাজসেবা বিভাগ কর্তৃক নিবন্ধিত হতে হবে। দুই. প্রতিষ্ঠানটির আয়কর শনাক্তকরণ নম্বর থাকতে হবে এবং প্রতিবছর আইন অনুযায়ী আয়কর রিটার্ন বা আয় ও ব্যয়ের বিবরণী দাখিল করতে হবে। তিন. প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বা সদস্যরা ও তাঁদের আত্মীয়-পরিজন প্রতিষ্ঠান থেকে কোনোভাবেই আর্থিক লাভ, যেমন বেতন-ভাতা, ফি, লভ্যাংশ, ইত্যাদি গ্রহণ করতে পারবেন না। চার. সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ আয়কর বিভাগে দাখিলকৃত প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের স্থিতিতে ও আয়-ব্যয়ের বিবরণীর অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।
বাংলাদেশে বয়স্ক লোকের সংখ্যা, আর্থিক বৈষম্য, রোগবালাই বৃদ্ধির কারণে সামজিক সুরক্ষার প্রয়োজন ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। সরকারের একার পক্ষে এ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে নয়। তাই এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপিত দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করার জন্য আয়কর অব্যাহতি ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এসব সুবিধার অপব্যবহার রোধের জন্য আইন ও বিধিগত শর্ত আরোপ ছাড়াও লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমাদের আশা, অটিজম নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুবিধা দিয়ে যে শুভসূচনা করা হয়েছে, শর্ত পূরণকারী অনুরূপ দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে একই সুযোগ দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা ও এ ধরনের প্রতিষ্ঠান যাতে দীর্ঘমেয়াদি সেবা প্রদান করতে সক্ষম হয়, সে জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ