১.
আমার লেখা ‘আত্মহত্যা ও গণতন্ত্রবিষয়ক একটি অতিদরকারি আলোচনা’ শিরোনামের একটি নিবন্ধ থেকে কিছু বক্তব্য আবারও তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছি। লিখেছিলাম—জার শাসনে রাশিয়ায় প্রচুর আত্মহত্যা হতো। কারণ ‘এই জীবনের কী-ইবা দাম’ ধরনের হতাশা। ১৯১৭ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিন থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত আত্মহত্যা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এল। কারণ চারদিকে আশা আর আশা। পরিবর্তনের, সাম্যবাদের, সুদিনের রঙিন স্বপ্ন আধমরাদেরও ঘা মেরে বাঁচিয়ে তুলল। ১৯২৪ থেকে আশাভঙ্গ শুরু হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আত্মহত্যাও বাড়তে লাগল। ১৯৬৫ সালে প্রতি লাখ মানুষে ১৭ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছিল। ১৯৮৪ সালে এই হার হয়ে গেল লাখে ৩০ জন। কারণ সমাজতন্ত্র ছাড়া অন্য যেকোনো ভিন্ন বিশ্বাসের অনুসারীকেই দেশদ্রোহী ও পুঁজিবাদী চর আখ্যায় ভিলেন বানিয়ে শেষ করে দেওয়ার রাস্তায় নেমে পড়েছিল রাষ্ট্র। ১৯৮৪-এর শেষ দিকে কমিউনিস্ট পার্টিতে সামাজিক গণতন্ত্র ও উদারবাদকে স্থান দেওয়ার আলোচনা শুরু হওয়ামাত্রই দেখা গেল আত্মহত্যার হার ধপাধপ পড়তে শুরু করেছে। ১৯৮৪-তে যেখানে আত্মহত্যার হার ছিল লাখে ৩০ জন, ১৯৮৮ সালেই তা বিস্ময়করভাবে নেমে গেল লাখে ২০ জনে। আবারও আশা আর সুদিনের স্বপ্ন।
আশাবাদ সোভিয়েত জনগণকে বাঁচতে ও বাঁচাতে আগ্রহী করে তুলল। নব্বইয়ে সমাজতন্ত্রের পতনের পর হুট করেই পশ্চিমের সংস্কৃতি, দর্শন, পণ্য, আদর্শ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রতিযোগিতা, বাজারব্যবস্থা ইত্যাদি দেশগুলোতে হুড়ুমুড়িয়ে ঢুকে পড়ায় প্রেম-ভালোবাসা, পারিবারিক বন্ধন, স্বপ্ন-সাধ আবারও এলোমেলো হতে থাকল। ১৯৯৮-তে গোদের উপর বিষফোড়া হিসেবে অর্থনৈতিক-সংকট আরম্ভ হলো। ফলাফল আত্মহত্যার আরেক দফা উল্লম্ফন। ১৯৯৯-তে আত্মহত্যার হার হয়ে গেল লাখে ৫৪ জন। দিনকাল ভালো হতে থাকায় ২০১৩-তে এই হার আবার অর্ধেকে নেমে এল। পুতিনের একনায়কসুলভ আচরণের পরও সামাজিক স্বস্তি বা সামাজিক সুরক্ষাকবচ উন্নত হওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা কমেছে, আশাবাদ বেড়েছে। বড় কোনো অর্থনৈতিক বিপর্যয়েও রাষ্ট্র সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, এই বিশ্বাস শক্তপোক্ত হয়েছে। ফলস্বরূপ ২০১৮ সালে আত্মহত্যা নেমে এসেছে লাখে ১২ দশমিক ৪ জনে। অর্থাৎ আশাবাদ মানুষকে বাঁচার অনুপ্রেরণা জোগায়। ‘সংসার সাগরে সুখ-দুঃখ তরঙ্গের খেলা, আশা তার একমাত্র ভেলা’ কথাটি একেবারে মিথ্যা নয়।
সমাজবিজ্ঞানী দুর্খেইম আত্মহত্যার কারণ ও ধরন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের জন্য বিখ্যাত। তাঁর বিশ্লেষণ আজ পর্যন্ত অখণ্ডনীয়। তিনি ‘অ্যানোমি’-কে দায়ী করলেন। ‘অ্যানোমি’ ইংরেজিতে গৃহীত ফরাসি মূল শব্দ, যার সহজ বা গ্রহণযোগ্য কোনো বাংলা প্রতিশব্দ এখনো নেই। তবে ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘নর্মলেসনেস’-কে বাংলা করে বলা যায় ‘চূড়ান্ত আশা-ভরসাহীন হয়ে জীবনবোধ সম্পূর্ণ খুইয়ে ফেলা’। এই অবস্থার শেষ পরিণতি আত্মহত্যা। দুর্খেইম দেখালেন ধর্মাচারীরা বা অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল, জিপসি, বেদুইন, ভবঘুরে, ভিক্ষুক ইত্যাদি নানা ধরনের মানুষ, যাঁরা বড় কোনো উচ্চাশা বা প্রত্যাশার জীবন যাপন করেন না, তাঁদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে কম। তিনি ছয় রকমের আত্মহত্যার ধরন উল্লেখ করলেন। কিন্তু একাকিত্ব হতে মানুষ আত্মহত্যা করে—এমন কথা কখনো বলেননি। ছয়টি প্রকরণের সবগুলোরই অনুঘটক কোনো না কোনোভাবে ‘অ্যানোমি’ বা দিকনির্দেশনাহীন দিশেহারা বিভ্রান্ত অবস্থা—‘আশাবাদ’-এর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা।
২.
সংবেদনশীল ও সৃষ্টিশীল মানুষ নিজেদের সমগোত্রীয়, সমমনস্ক বা সমকক্ষ বন্ধু-স্বজন না পেয়ে একাকিত্ব বোধ করতে পারেন। সংবেদনশীল কবি আবুল হাসান যেমন লিখেছিলেন—‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা! জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা।’ হাজারজনের মধ্যে বাস করেও কিছু কিছু মানুষ একাকিত্ব বোধ করতে পারে। একাকিত্ববোধ নিঃসন্দেহে মানসিক অসন্তুষ্টির কারণ, কিন্তু আত্মহত্যার কারণ হতে পারে না। সম্প্রতি আবু মহসিন খান নামে এক ব্যবসায়ীর আত্মহত্যার পর সামাজিক মাধ্যমসহ সব মাধ্যমেই ব্যাপক আলোচনা চলছে। অনেকেই তাঁর সন্তান, বন্ধু-স্বজন ও নিকটজনদের তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী করছেন। সে জন্য তাঁর সুইসাইড নোট নিঃসন্দেহে খানিকটা দায়ী। অভিমানের কথা মানুষ কাগজে লেখে। সেখানে অস্বাভাবিকতা নেই। তাঁর প্রত্যাশা ছিল সবাই এ সময় তাঁর পাশে থাকুক। এ রকমটি শুধু তিনি নন, মানুষমাত্রই প্রত্যাশা করে।
পুঁজিবাদী সমাজে প্রত্যক মানুষেরই নানা রকম বিচিত্র টানাপোড়েন ও অক্ষমতা থাকে। সেসব মেনে নেওয়ার প্রস্তুতি থাকতে হয়। তিনি চাইলেই তাঁর নিকটজন প্রত্যাশা মেটাতে সক্ষম না-ও হতে পারেন। এটিই বাস্তবতা। তিনি বাস্তব বা ‘সত্যরে লও সহজে’ মনোভঙ্গিটি আয়ত্ত করতে পারেননি, সন্দেহ নেই। তাঁর মৃত্যুর জন্য অন্য সবাইকে অপরাধী বানিয়ে, কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তীব্র অপরাধবোধে ভোগানো কি আত্মহত্যা কমাতে কোনোভাবে সাহায্য করবে? উত্তর-‘না’।
আত্মজ-আত্মজা, বন্ধু ও স্বজন দ্বারা অবহেলার বঞ্চনা ও কৃতঘ্নতার ঘটনা সমাজে একটি-দুটি নয়, কোটি কোটিই আছে। আসলে সেগুলো প্রতিদিনই ঘটছে। সবাই আত্মহত্যা করেন না, বা করবেন এমনটিও ভাবেন না। কারণ জীবন একটিই। যাত্রাও একমুখীই। একবার হারালে আর ফিরে পাওয়া যায় না। সংগ্রামও জীবনেরই অংশ। সবার সেই সংগ্রামের মানসিক ধৈর্য, সহ্য বা জীবনবোধ সমান নয়। কারও কম, কারও বেশি। তাই প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির যোগ না হলেই তাঁরা ‘অ্যানোমি’গ্রস্ত হয়ে ওঠেন। জনাব মহসিন তাঁরই প্রমাণ রাখলেন।
পুঁজিবাদী সমাজে প্রত্যক মানুষেরই নানা রকম বিচিত্র টানাপোড়েন ও অক্ষমতা থাকে। সেসব মেনে নেওয়ার প্রস্তুতি থাকতে হয়। তিনি চাইলেই তাঁর নিকটজন প্রত্যাশা মেটাতে সক্ষম না-ও হতে পারেন। এটিই বাস্তবতা। তিনি বাস্তব বা ‘সত্যরে লও সহজে’ মনোভঙ্গিটি আয়ত্ত করতে পারেননি, সন্দেহ নেই। তাঁর মৃত্যুর জন্য অন্য সবাইকে অপরাধী বানিয়ে, কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তীব্র অপরাধবোধে ভোগানো কি আত্মহত্যা কমাতে কোনোভাবে সাহায্য করবে? উত্তর-‘না’। ‘একাকিত্ব’ও কারণ মোটেই নয়। জীবনবোধ খুইয়েছেন, সেটিই আসল কারণ।
৩.
ব্যবসায়ী মহসিনের আত্মহত্যা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দেওয়ার কারণ তিনি ধনী, চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর এবং নাটকীয় আত্মহত্যাটিও বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম, সেই সঙ্গে অভাবিতপূর্ব। আদালত ছয় ঘণ্টার মধ্যে ভিডিওটি সব ডিজিটাল মাধ্যম থেকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে মহৎ। যাতে কেউ উৎসাহিত না হতে পারে, ‘কপিক্যাট সিন্ড্রোম’-এর ফাঁদে পড়ে একই পদ্ধতি নকল না করে, শিশু, দুর্বলচিত্ত ও হৃদ্রোগীদের মনোবিপর্যয় বা ভীতিবিহ্বলতার কারণ যেন না ঘটে ইত্যাদি। তবে এর ক্ষতিকর দিক যাঁরা দেখেননি, তাঁদের উৎসাহ যেমন বাড়বে, দৃষ্টির অগোচরে প্রদর্শনী এবং ছড়িয়ে দেওয়াও সমানভাবে বাড়বে। তাতে উপকারের চেয়ে অপকারের আশঙ্কাই বাড়বে।
জনাব মহসিনের হত্যাকাণ্ডে ফেসবুক সরব। অধিকাংশের মত এই যে একাকিত্ব তাঁকে জীবনঘাতী করেছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের এ রকম ত্বরিত সিদ্ধান্তে নেমে যাওয়া বিপজ্জনক। কারণ ঘটনা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, আত্মহত্যার মতো মারাত্মক সামাজিক সমস্যাটিকে এ দেশের সমাজের তুলনামূলক অগ্রসর জনগোষ্ঠীও বিনোদনের বিষয়ে পরিণত করেছে। নইলে নিত্যদিনের অসংখ্য হৃদয়বিদারক আত্মহত্যার ঘটনাকে তাঁরা নিত্যনৈমিত্তিক স্বাভাবিক ঘটনা ভেবে চলেছেন কীভাবে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাতে গত বছর জানা গিয়েছিল যে বাংলাদেশ পৃথিবীর আত্মহত্যাপ্রবণ দেশের তালিকায় দশম স্থানে রয়েছে। প্রতিদিন বাংলাদেশে ২৮ জন আত্মহত্যা করেন, যার দুই-তৃতীয়াংশ নারী। চলতি সপ্তাহে প্রথম আলোর একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘এক বছরে ১০১ জন ছাত্রের আত্মহত্যা’। ২০২০ সালে সংখ্যাটি ছিল ৭৯। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে দৈনিক ইনকিলাবের একটি খবরের তথ্যমতে, যশোরে মাত্র চার মাসে ১৮২ জন আত্মহত্যা করেছে। ২০২১ সালের ১৩ মার্চ প্রথম আলো উন্নয়ন সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণা তথ্যের আলোকে জানিয়েছিল যে ২০২০ সালে ১৪ হাজার ৮৩৪টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। আত্মহত্যার এ রকম চলমান ঘটমান মহামারিও মানুষকে আতঙ্কিত করে না। অথচ একজন মহসিনের আত্মহত্যার ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমের প্রায় সবাই বিশেষজ্ঞের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কারণ কি শুধু এটিই নয় যে তিনি রিয়াজের শ্বশুর, সচ্ছল এবং আমাদের মনোজগতে এই ভুল ধারণাটি বদ্ধমূল হয়েই আছে যে সচ্ছল মানুষমাত্রই সুখী এবং তাঁদের আত্মহত্যা করার কথা নয়?
২০১৮ থেকে বর্তমান পর্যন্ত আত্মহত্যাবিষয়ক একই ধরনের অসংখ্য সংবাদ শিরোনাম থেকে মাত্র সামান্য কয়েকটি সাম্প্রতিক শিরোনাম দৈবচয়নের মাধ্যমে তুলে ধরছি। ‘জিপিএ পাঁচ না পাওয়ায় কিশোরীর আত্মহত্যা’, ‘সুনামগঞ্জে ক্ষুধার তাড়নায় বিধবার আত্মহত্যা’, ‘দিরাইয়ে ক্ষুধার তাড়নায় আত্মহত্যা দুজনের’, ‘কুষ্টিয়ায় পুত্রবধূর দেওয়া গয়না চুরির অপবাদ সইতে না পেরে বৃদ্ধের আত্মহত্যা’, দুই শিশুসন্তানকে হত্যার পর স্বামী পরিত্যক্তা নারীর আত্মহত্যা’, ‘ঋণের দায় মেটাতে না পেরে সপরিবার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত’, ‘মায়ের বকুনিতে অভিমানে কিশোরীর আত্মহত্যা’। ক্ষুধার জ্বালায় বা অপরাপর বিচিত্র কারণে যাঁরা আত্মহত্যা করেন, তাঁদের বিষয়ে নিস্পৃহতা, কিন্তু সচ্ছলদের আত্মহত্যায় অতিমনোযোগও সমস্যাজনক। সাম্প্রতিক জনপ্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্ট যে জনপরিসরে আত্মহত্যা-সম্পর্কিত ভুল ধারণা এখনো প্রকট। একাকিত্বকে একটি কারণ বিবেচনা করা বৃহত্তর মূল সমস্যা থেকে আমাদের দৃষ্টিকে আরও সংকীর্ণতার দিকে ঠেলে না দিক।
হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ