সংস্কৃতি অঙ্গনে রক্তশূন্যতা কেন
এবার ঈদে টেলিভিশনে ভালো নাটক কী হলো, এই প্রশ্ন করেছিলাম তরুণতর বন্ধুদের। কেউ বললেন, বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখা হয় না। কেউ বললেন, ‘এবার? কই? তেমন কিছু তো দেখলাম না।’ প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কলকাতার লোকজন একটা সময় দিনের পর দিন অপেক্ষা করত। কখন বাংলাদেশের নাটকগুলোর ক্যাসেট বা সিডি পাইরেসি হয়ে কলকাতায় যাবে, আর তারা সেই কপি কিনে পরিবারসহ বসে নাটক দেখবে। কলকাতার এক বন্ধুই আমাকে এই কথাটা বলেছিল।
এখনকার বাস্তবতা, ওদের সিরিয়াল আমরা সপরিবার বসে বসে দেখি। তাদের তুলনায় দেশি চ্যানেলগুলোর দর্শকপ্রিয়তা নেই বললেই চলে। কেন এমন হলো, দর্শক হিসেবে এই বিতর্কে গেলে অনেক কিছু বলতে হবে। তা সঠিক না–ও হতে পারে। তাই ওই বিতর্কে গেলাম না।
টিভিতে নাটক দেখা ছেড়েই দিয়েছিলাম, ইউটিউবে পুরোনো নাটকগুলো মাঝেমধ্যে দেখতাম। এখন হয়েছে আরেক যন্ত্রণা। ইউটিউবও দখল করে নিচ্ছে কিছু বস্তাপচা অশ্লীল নাটক(!)। টিভি নাটকে তা–ও কিছু মান ছিল, রিভিও হয়ে প্রচার হতো। অবাধ তথ্যপ্রবাহের এই যুগে ইউটিউবে ইদানীং নাটকের নামে যা আসছে, তা লজ্জাজনক। টুকরো টুকরো করে যা নজরে আসছে, তা অশ্লীলতা ছাড়া আর কিছুই না। ইউটিউব একটি স্বাধীন জায়গা, এইখানে অশ্লীলতাকে পুঁজি করে ‘বেশি ভিউয়ের’ নামে একটি প্রজন্মের চিন্তাভাবনা, রুচিকে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। এর পেছনে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, আমি জানি না। তবে এগুলো চলতে থাকলে সামনে ভয়ংকর দিন আসছে নিশ্চিত।
সংস্কৃতির নামে যাঁরা বা যে গোষ্ঠী এসব করছে, তাঁদের মনে রাখা উচিত, আপনারা আমরা মারা গেলে জাতির খুব একটা ক্ষতি নেই, নতুন কেউ না কেউ আসবে। কিন্তু কালচার ধ্বংস করে ফেললে শত বছর ধরে এই জাতিকে পস্তাতে হবে।’
শুধু টিভি নাটক নয়, শিল্প-সাহিত্যেও খুব ভালো কাজ তো দেখছি না। সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক চিত্র হয়তো চলচ্চিত্র অঙ্গনের। আমাদের অঞ্চলে সিনেমা শুরু হয়েছিল উন্নততর মান নিয়ে। এখানে অস্কার পাওয়া সিনেমাটোগ্রাফাররা কাজ করেছেন। ১৯৬০–এর দশকে উর্দু ছবি, ভারতীয় বাংলা ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢাকা শহরে ছবি বানানো হয়েছে। স্বাধীনতার পরও সিনেমা হলগুলো দর্শকে গমগম করত। সত্তর দশকে দেখেছি, নতুন ছবি মুক্তি পেলে তা দেখার পথে প্রধান বাধা ছিল টিকিটের কালোবাজারি, হলের টিকিট কাউন্টারের সামনে প্রচণ্ড ভিড়, কতগুলো ‘ব্ল্যাকার’ ধাক্কাধাক্কি করে সামনে গিয়ে টিকিট কেটে ফেলত, আর একটু পরে কাউন্টারে বলা হতো, টিকিট শেষ। বছর কয়েক আগেও শাকিব খানের ছবিগুলো চলত। এখন কিছুই চলে না?
ভালো গান কী কী হচ্ছে? বছর কয়েক আগেও হাবিব কিংবা অর্ণবের নতুন অ্যালবাম কী বেরোচ্ছে, তা নিয়ে মানুষের আগ্রহ ছিল। এবার দুই ঈদে কোন অ্যালবাম মুক্তি পেল?
ভালো গল্প-উপন্যাসই-বা কী লেখা হচ্ছে? নতুন কণ্ঠ কই?
সার্বিক অবনমন দেখতে পাচ্ছি। কারণ কী?
একটা হলো, লুটেরা পুঁজির দৌরাত্ম্য। চারদিকে শুধু খাই খাই আওয়াজ। লুৎফর রহমান রিটনের ভাষায়, ‘আবদুল হাই, করে খাই খাই, এক্ষুনি খেয়ে বলে কিছু খায় নাই। বন খায়, ভূমি খায়, নদী খায়, সেতু খায়, ব্যাংক খায়, বিমা খায়, বালিশ খায়।’ এই সময়ে ঠান্ডা মাথায় কারও পক্ষে কি শিল্পের সাধনা আরাধনা করা সম্ভব? খারাপ টাকা শুধু ভালো টাকা ঝেঁটিয়ে বিদায় করে তা-ই নয়, খারাপ টাকা ভালো, শুদ্ধ, শিল্পিত সব সম্ভাবনাকেও মত্ত হাতির পদতলে পিষ্ট করে।
প্রযুক্তির বদল আরেকটা কারণ। দেড় বছরের বাচ্চা মায়ের মোবাইল ফোন নিয়ে তর্জনী ঘষছে, বুড়ো আঙুলের চাপে মুহূর্তে বের করে ফেলছে ইউটিউবে তার পছন্দের কার্টুন অ্যানিমেশন। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কি পথের পাঁচালী পড়ে শেষ করতে পারবে? সত্যজিতের পথের পাঁচালী দেখে শেষ করতে পারবে? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, বেশির ভাগই উত্তর দিয়েছে, না, বড্ড বেশি স্লো!
আর আছে কার কত ভিউ হলো, সেই প্রতিযোগিতা। মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আজকে নতুন ছেলেদের সঙ্গে কথা বললে দেখি, ভিউয়ের চাপে তারা ম্রিয়মাণ! তারা নতুন ছবি বানানোর, নতুন সুর করার, নতুন কথা লেখার আগেই ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ খাবে তো? তার দোষই–বা কী? তাকে সমর্থন দিয়ে এগোতে সাহায্য করবে, সেই ভোক্তা কই?’
পাড়ায় পাড়ায় সন্ধ্যায় আর হারমোনিয়ামের সুর শোনা যায় কি? গ্রামে–গঞ্জে যাত্রা হয়? পালাগান হয়? জেলা শহরগুলোয় মঞ্চনাটক হয়? বোধ হয়, মঞ্চনাটকে এখনো কিছু ভালো করার চেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু দুই কোটি মানুষের শহরে ৩০০ আসনের মিলনায়তন খুব কমই পূর্ণ হয়।
এই রকম ধূসর সময়, বন্ধ্যা সময় আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে আর কখনো এসেছিল কি? সিনেমা নেই, গান নেই, টিভি নাটক নেই! সিনেমা হল নেই, টিভি চ্যানেলগুলো লোকসান দিতে দিতে বন্ধ হওয়ার মুখে। ব্যাপক লোক ছাঁটাই চলছে এবং চলবে।
এমন কেন হলো? উত্তরগুলো ভাবার চেষ্টা করি। আমাদের সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে একটা উৎকর্ষের কাল ছিল ১৯৫০-এর দশক। যাঁরা মাতৃভাষার আন্দোলন করেছিলেন, তাঁরা বড় হয়েছেন সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে, বিশ্বসাহিত্যের পটভূমিতে। ফলে আমরা শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পেয়েছিলাম। তারপর এল উত্তুঙ্গ ষাটের দশক। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কণ্ঠস্বর কিংবা সিকান্দার আবু জাফরের সমকাল ঘিরে নতুন সাহিত্য আন্দোলন দানা বাঁধল। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শিক্ষার বিস্তার ঘটল, কিন্তু মান গেল কমে। লাখ লাখ স্কুলগামী পাঠকের বই পড়ার এবং টেলিভিশন উপভোগের বিপুল তৃষ্ণা মেটাতে এগিয়ে এলেন হুমায়ূন আহমেদ। তারও আগে তরুণেরা ভাষা আন্দোলন করেছেন, ছায়ানট গড়েছেন, স্বাধিকার আন্দোলন করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন পর্যন্ত তরুণদের মধ্যে একটা আদর্শবাদিতা ছিল।
এখন শুধুই ক্যারিয়ার। আগের নেতারা খদ্দর পরতেন, এখন তঁারা টয়োটা প্রাডো চড়েন, তাঁদের সামনে-পেছনে কয়েক শ লোক তাঁদের এসকর্ট করে। ছাত্রনেতারাও তা-ই করেন। প্রত্যেকের ব্যবসা আছে। মানুষের সেবায় আত্মত্যাগ করতে আসেননি, আত্মোন্নয়ন করতে এসেছেন। সংস্কৃতির নেতাদেরও নানা স্বার্থচিন্তা। চিন্তার জগতে কোনো বিদ্রোহ নেই। অথচ বুদ্ধিজীবী তো তিনিই, যিনি সমাজে প্রচলের বিরুদ্ধে চিন্তার বিদ্রোহ করবেন।
আজ ভালো ছেলেরাও ক্যারিয়ার নিয়ে মগ্ন। বছরে ১০ লাখ মানুষ কাজের সন্ধানে বিদেশে যায়। পড়তে বিদেশে যায় ৬০ হাজার।
যাঁরা একদা ছায়ানট গড়েছিলেন, উদীচী করতেন, জীবন থেকে নেয়া ছবি বানাতেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে; এবং বিদেশে চলে যায়। প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠালে আমাদের টাকার অভাব হবে না। দুই হাজার কোটি টাকা চুরি হলেও আমরা বলতে পারব, এ আর এমন কী! কিন্তু দেশটা যে রক্তশূন্য হয়ে পড়ছে সাংস্কৃতিক শূন্যতার কারণে, এটা কি আপনারা টের পাচ্ছেন?
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক