মিডিয়ার কল্যাণে গ্রাফিতি ‘সুবোধ’ এখন পরিচিত নাম। ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না’; কিংবা ‘সুবোধ, কবে হবে ভোর’। ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে এ রকম বাক্য এবং সঙ্গে আঁকা খাঁচাবন্দী সূর্যের ছবি অনেকেরই নজরে পড়েছে। এসব ছবি যাঁরা আঁকেন, তাঁদের গ্রাফিতিশিল্পী বলা হয়। সাধারণত রাতের অন্ধকারেই তাঁরা কাজটি করেন। যেহেতু তাঁরা রাজনৈতিকভাবে প্রতিবাদী বক্তব্য হাজির করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরিসরে, স্থাপনায় বা দেয়ালে অবৈধভাবে ছবি আঁকেন, তাই তাঁরা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করেন না। ফলে এই ‘সুবোধ’-এর পেছনে কে বা কারা জড়িত, এটা অজ্ঞাতই থেকে যাচ্ছে। পুলিশ অবশ্য এই গ্রাফিতিশিল্পীকে খুঁজে বের করার প্রয়াস নিয়েছে।
কদিন আগে ডেইলি স্টার পত্রিকা একটা নির্দোষ রম্যরচনা লিখল সুবোধকে নিয়ে। সেখানে লেখা হলো, সুবোধকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। লেখাটি যে রম্যরচনা, সেটি লেখার সঙ্গে দৃশ্যমানভাবে উল্লেখ করাও ছিল। কিন্তু একাধিক জাতীয় দৈনিকসহ নানা অনলাইন সংবাদমাধ্যম সেটা প্রচার করল সুবোধের গ্রেপ্তারের খবর হিসেবে। ফলে সমাজে এ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলো।
এক সহকর্মী সেদিন তাঁর সাবেক কর্মস্থলের কথা বলছিলেন। কোনো একটি টেলিভিশনের নিউজে কাজ করতেন তিনি। তো, একবার কোনো এক মেয়র গুলিবিদ্ধ হয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আনীত হলেন। কিছুক্ষণ পরই সেই টেলিভিশন চ্যানেল স্ক্রল দেখাতে শুরু করল যে তিনি মারা গেছেন। ঘণ্টাখানেক বা তারও বেশি সেই স্ক্রল চলল। তখন বার্তাকক্ষ-প্রধান জানতে পারলেন যে ওই মেয়র আইসিইউতে আছেন, তখনো মারা যাননি। অথচ টেলিভিশনের সুবাদে দেশবাসী জেনে গেল যে তিনি মারা গেছেন। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ প্রমাদ গুনল। খোঁজখবর নিয়ে জানল, ওই মেয়রের সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। তখন তারা প্রার্থনা করতে বসল। নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না যে তারা তখন মেয়রের সুস্থতার জন্য প্রার্থনায় বসেনি।
এ রকম কেন ঘটছে? টেলিভিশনের কাজ সম্প্রচার করা, অথচ সে দেখছি আবহাওয়া অফিসের মতো পূর্বাভাস দিতে শুরু করেছে! পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যমের কাজ নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাতে সংবাদ প্রচার করা, অথচ সে ভুলভাল খবর কপিপেস্ট করে ছাপিয়ে দিচ্ছে! কোনো সূত্র নির্দেশ নেই, যাচাই-বাছাই নেই, নেই ন্যূনতম বাছবিচার। ক্রমাগত মিথ্যা আর ভুলের বেসাতি করতে করতে এসব সংবাদমাধ্যমের অবস্থা হয়েছে মিথ্যাবাদী রাখালের মতো। সত্যি কথা বললেও কেউ আর বিশ্বাস করে না তাদের।
তবে একটা জিনিস এসব সংবাদমাধ্যম ভালোই অনুসরণ করে চলেছে। যাকে বলে ‘ইমিডিয়েসি’ বা তাৎক্ষণিকতা, অর্থাৎ ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে খবর প্রকাশ করার তাড়া। অনলাইন মাধ্যমগুলো মোটামুটিভাবে এই প্রবণতার জনক, যেহেতু তারা যেকোনো সময় খবর প্রকাশ করতে সক্ষম। যেহেতু সংবাদপত্রের মতো তাদের আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। ফলে একসময় দেখা গেল, যেসব খবর ছাপামাধ্যমে আগামীকাল শিরোনাম হবে, তারা অনলাইন সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে আজই বাসি হয়ে গেছে।
অচিরেই ছাপা সংবাদপত্রগুলো অনলাইন মাধ্যমের এই সুবিধায় ভাগ বসাতে শুরু করল। প্রথমে তারা তাদের অনলাইন সংস্করণ নিয়মিতভাবে হালনাগাদ করতে শুরু করল। তাতেই অনেক অনলাইন সংবাদমাধ্যম পাঠক হারাতে লাগল। ফলে অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো সেনসেশনাল বা রগরগে খবরের দিকে আরও বেশি মাত্রায় ঝুঁকে গেল। তারা টার্গেট করল সেসব খবর, যেগুলো সাধারণত দৈনিক পত্রিকার ছাপা সংস্করণে প্রকাশ পায় না। ক্রমে এখানেও তাদের মনোপলিতে ভাগ বসাল ছাপা দৈনিক পত্রিকার অনলাইনগুলো। এখন বেশির ভাগ দৈনিক পত্রিকার ছাপা সংস্করণ আর ওয়েব সংস্করণ আলাদা। ওয়েব সংস্করণ অনেক
বেশি সেনসেশনাল, তাৎক্ষণিকতা-আক্রান্ত এবং সংগত কারণেই ভুলে ভরা। কিন্তু ছাপা সংস্করণে তারা মান বজায় রাখার চেষ্টা করে। ভাবখানা এমন যে ছাপা সংস্করণ বৈঠকখানা আর ওয়েব একটা টয়লেট!
এই প্রবণতা এখানেই আটকে থাকলেও কথা ছিল। কিন্তু অনলাইন মাধ্যম আরও বেশি রগরগে হতে হতে সংবাদ প্রচারের কোটরের মধ্যেই থাকতে চাইল না। তারা সামাজিক গণমাধ্যমে বেশি পাঠক পাওয়ার আশায় আরও আগ্রাসী ভূমিকায় নামল। সেটা শুধু কাল্পনিক বা ভুয়া খবর প্রচার করার মাধ্যমেই নয়, আরও নানা অস্ত্র আছে তাদের। যেমন উত্তেজক শিরোনাম, যার সঙ্গে মূল খবরের কোনো যোগাযোগই নেই। খবরের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক কিন্তু উত্তেজক বা আকর্ষণীয় ছবি। আর অপরাধসংক্রান্ত খবরের ক্ষেত্রে তারা নীতি–নৈতিকতার ধারই ধারে না। অপরাধের শিকার কিংবা সম্ভাব্য অপরাধীর ছবি প্রকাশ করার মাধ্যমে সংবাদ প্রচার করা, অনুমান কিংবা নেহাত গুজবকে সত্যের মোড়কে পরিবেশন, বাণিজ্যিক কিংবা অন্যান্য অভিসন্ধি নিয়ে সংবাদ প্রচার, নিজেদের কাটতি নিয়ে সাজানো পরিসংখ্যান হাজির করা—এ রকম অনেক প্রবণতাই আমরা দেখছি অনলাইন সাংবাদিকতায়। অভিসন্ধির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অজ্ঞতা। সাংবাদিকতার নৈতিকতা সম্পর্কে ন্যূনতম জানাশোনা না থাকায় এবং প্রাতিষ্ঠানিক যোগসূত্রের অভাবে অনেক সাংবাদিকের পক্ষে সৎ সাংবাদিকতা জিনিসটা বোঝার অগম্যই থাকছে।
এভাবে গোটা দুনিয়াতেই সাংবাদিকতার চরিত্রে একটা গুরুতর পালাবদল ঘটে গেছে। সত্য প্রকাশের দায়িত্ব থেকে ক্রমাগত সরে গিয়ে এখন সে সত্য উৎপাদকের দায়িত্ব যেন নিতে চাইছে! আর এই উৎপাদনের চেহারাও ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। কখনো দেখা যাচ্ছে, একটি সংবাদ প্রচারের ভেতরেই নানা রকম আলো-ছায়ার ইশারা: আংশিক সত্য, আংশিক মিথ্যা, আংশিক সাংবাদিকতা, আংশিক অজ্ঞতা, আংশিক রাজনীতি, আংশিক বিনোদন, আংশিক ধান্দাবাজি—সব মিলিয়ে এমন একটি প্যাকেজ পাঠকের সামনে হাজির হয় যে একমাত্র শার্লক হোমস ছাড়া এর ভেদবিচার কারও পক্ষে নিতান্ত অসম্ভব।
তার মানে এই নয় যে পাঠক নিতান্ত অসহায়। এসব প্রবণতা অনেক পাঠকই ঠিকঠাক ধরতে পারেন। ফলে ওই মাধ্যমের ব্যাপারে তিনি সতর্কও থাকতে পারেন। কিন্তু কখনো কখনো অনেক দেরি হয়ে যায়। অনেক ক্ষতিও হয়ে যায়। আর এই প্রবণতা এমন মহামারি আকার ধারণ করেছে যে নির্ভর করার মতো সংবাদমাধ্যম অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজে বের করতে হয়।
এই সর্বব্যাপী মজারু-সাংবাদিকতার যুগে, সত্য ‘বানানোর’ এই ধ্বংসাত্মক প্রতিযোগিতার যুগে, সাংবাদিকতাকে তার সাবেকি দায়িত্বটুকু মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি। কিন্তু সেটা কেবলই ধর্মপ্রচারকের ভূমিকা নিয়ে করলে কোনো ফায়দা হচ্ছে না। সংবাদমাধ্যমকে নজরদারির মধ্যে আনা জরুরি। সরকারি বা আইনি নজরদারি নয়, বরং গণনজরদারি। সেটার নানা উপায় আছে। সবচেয়ে জরুরি যেটা, প্রতিটি সংবাদমাধ্যম
তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে তথ্য যাচাই করবে। নিশ্চিত না হয়ে কোনো সংবাদ প্রচার করবে না। ফলে তাৎক্ষণিকতার ইঁদুরদৌড়ে প্রথম না হয়ে বরং উপকথার কচ্ছপের ধীর কিন্তু নিশ্চিত পদক্ষেপে আগাবে। কিন্তু এই সামর্থ্য, প্রস্তুতি ও প্রতিজ্ঞা অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমেরই নেই। ফলে এসব বক্তব্য তাদের কর্ণকুহরে ঢোকে না। অন্য কিছু দরকার।
খুব সাম্প্রতিককালে ‘ফ্যাক্ট চেকিং’ বলে একটি উদ্যোগ শুরু হয়েছে। ফ্যাক্ট চেকিং বা তথ্য যাচাইকে অনেকটা কাউন্টার জার্নালিজম
বা প্রতিসাংবাদিকতা বলা যায়। এটি মূলত একটি অনলাইনভিত্তিক উদ্যোগ, যেখানে সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যের সংগতি যাচাই করা হয়। ভুয়া বা বানোয়াট সংবাদ, সংবাদের সঙ্গে বানোয়াট ছবি বা ভিডিও, দায়িত্বহীন বক্তব্য ইত্যাদি বিষয়কে এখানে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এর সত্যতা নিরূপণ করা হয়। সামাজিক মাধ্যমনির্ভর দুনিয়ায় এ রকম বানোয়াট খবর প্রচারের ভয়াবহ পরিণতি হয়। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতনের ছবি বা ভিডিও যখন ভারতের বলে চালিয়ে দেওয়া হয়, ভারতের কোনো একটি নির্যাতনের ভিডিও যখন বাংলাদেশের মুসলিম নির্যাতনের ভিডিও বলে ফেসবুকে প্রচার করা হয়, তখন তা থেকে দাঙ্গার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব যে হচ্ছে, তা আমরা সবাই জানি।
মূলত অনলাইনে পাওয়া যায়, এমন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থাগুলো এই কাজ করে থাকে। ফলে এটি মূলত গবেষণাভিত্তিক কাজ। কঠিন ও পরিশ্রমসাধ্য। তবে সাংবাদিকতায় যে পরিমাণ কনটেন্ট উৎপাদিত হয়, ফ্যাক্ট চেকিংয়ের প্রতিসাংবাদিকতায় এর এক শ ভাগের এক ভাগকেও যাচাই করে দেখা সম্ভব নয়। তবু প্রধান প্রধান আলোচিত সংবাদ অন্তত খতিয়ে দেখা সম্ভব। ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে এটি এখন ভ্রূণ পর্যায়ে আছে। অচিরেই এটা কুটিরশিল্প আকারে ছড়িয়ে যাবে। একসময় হয়তো বড় ইন্ডাস্ট্রিও হয়ে উঠবে। আশার কথা, ইতিমধ্যেই মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো ফ্যাক্ট চেকিংয়ের উপযোগিতা অনুধাবন করতে শুরু করেছে। ওয়াশিংটন পোস্ট বা গার্ডিয়ান–এর আলাদা ফ্যাক্ট চেকিং কার্যক্রম আছে, যেখানে তারা অপরাপর সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদের তথ্যনিষ্ঠতা যাচাই করে। পাশাপাশি সংবাদমাধ্যম নয়, এমন স্বাধীন ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের উদ্যোগে ও পরিচালনায়ও তথ্য যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে অনেক জায়গায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় এ রকম একটি উদ্যোগ আছে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে একটি ফ্যাক্ট চেকিং বা তথ্য যাচাইয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের তথ্য যাচাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেটি যেমন সংবাদটি প্রচারের আগে ওই সংবাদমাধ্যম নিজের উদ্যোগে করবে, তেমনি তা প্রচারের পর তৃতীয় কোনো সংস্থা খতিয়ে দেখবে। এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম–ভিত্তিক সমাজব্যবস্থায়, এই তাৎক্ষণিকতার যুগে একটি দায়িত্বহীন বানোয়াট সংবাদ ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। গণনজরদারি এবং সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বশীল আচরণের মধ্য দিয়েই তাকে প্রতিরোধ করতে হবে।
সুমন রহমান: কবি, গল্পকার ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের শিক্ষক।