হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে এ বছর বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তাতে রাষ্ট্র বা সরকার কতটা বিচলিত জানি না; একজন নাগরিক হিসেবে লজ্জিত বোধ করছি। এ দেশে লজ্জার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। তাই বলে সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে ধর্মীয় উৎসব পালন করতে গিয়ে মানুষ খুন হবে, মন্দির, পূজামণ্ডপ, ঘরবাড়ি ভাঙচুর হবে—এটি কী রকম কথা? তাহলে আমরা নিজেদের কীভাবে সভ্য মানুষ দাবি করতে পারি?
কুমিল্লার পূজামণ্ডপের ঘটনা নিয়ে এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব একে অপরকে দায়ী করে লম্বা বিবৃতি দেবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ডজন ডজন মামলা করবে, গয়রহ সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের পাকড়াও করে জেলখানায় পাঠাবে; কিন্তু তাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, হৃদয় যে রক্তাক্ত হয়েছে, তার উপশম হবে না।
বাংলাদেশকে আমরা সম্প্রীতির দেশ বলি, কিন্তু সেই সম্প্রীতি রক্ষায় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়েরও যে দায়িত্ব আছে, সে কথা প্রায় ভুলে যাই। এমনকি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর দেশের বিভিন্ন স্থানে যে তাণ্ডব ঘটল, তার প্রতিবাদও প্রধানত তাদের করতে হচ্ছে, হবে। শনিবার চট্টগ্রামে হামলার প্রতিবাদে যে সমাবেশ হয়েছে, তাতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের কতজন উপস্থিত ছিলেন, কিংবা সারা দেশে কতগুলো প্রতিবাদ সমাবেশ বা মানববন্ধন হয়েছে, তার হিসাব নিলেই সংখ্যাগুরু মনস্তত্ত্বটা জানা যাবে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আক্রান্ত হলে আমরা বড়জোর পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে ‘উহ্, আহ্’ করে দায়িত্ব শেষ করি। কঠোর ভাষায় নিন্দা জানাই। কিন্তু সেই ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় ঘটনা বন্ধের কোনো উদ্যোগ নিই না। অন্যদিকে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার কথিত অভিযোগ কী ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, তা আমরা রামুতে দেখেছি, নাসিরনগরে প্রত্যক্ষ করেছি। প্রত্যক্ষ করেছি আরও অনেক স্থানে।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটে, যার শিকার হয়েছিলেন প্রধানত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। সে সময়ে নাগরিক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে ঢাকার কাছে কালীগঞ্জে গিয়েছিলাম, সেখানে এক সংখ্যালঘু বৃদ্ধা নারী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘দয়া করে ভোটার তালিকা থেকে আমাদের নামটি বাদ দিন। ভোটার তালিকায় নাম আছে বলেই আমরা ভোট দিতে যাই এবং ভোট দেওয়ার কারণে আমাদের বাড়িঘরে হামলা হয়, মন্দির ভাঙচুর করা হয়।’
এখনো সেই বৃদ্ধার কথা কানে বাজে। তাঁরা এ দেশের নাগরিক। এ দেশেই জন্ম। ভোটার তালিকা থেকে নাম দিয়ে হলেও এ দেশে থাকতে চান।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘুদের বাদ দিয়েছে। প্রথমে আমরা যে সংবিধান করলাম, সেখানে বাঙালি ছাড়া কাউকে স্বীকার করলাম না। এরপর রাষ্ট্রধর্ম চালু করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আইন করে বললাম, তোমার দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনেকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন? কিন্তু তাঁরা বলেন না, কোন পটভূমিতে এই সংগঠন তৈরি হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘুদের বাদ দিয়েছে। প্রথমে আমরা যে সংবিধান করলাম, সেখানে বাঙালি ছাড়া কাউকে স্বীকার করলাম না। এরপর রাষ্ট্রধর্ম চালু করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আইন করে বললাম, তোমার দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনেকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন? কিন্তু তাঁরা বলেন না, কোন পটভূমিতে এই সংগঠন তৈরি হয়েছিল। অষ্টম সংশোধনীর আগপর্যন্ত সংখ্যালঘুরা এ ধরনের কোনো সংগঠন করার কথা ভাবেননি। যে দেশে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, সে দেশেই এ ধরনের সংগঠন গঠন করতে সংখ্যালঘুরা বাধ্য হয়।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর কয়েক দিন ধরে যে সন্ত্রাসী হামলা হলো, তাদের মন্দির ও পূজামণ্ডপে ভাঙচুর করা হলো, সেসব ঘটনা সংখ্যাগুরুদের মনে খুব দাগ কেটেছে বলে মনে হয় না। বরং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা যেসব কথা বলছেন, তাতে আক্রান্তের ওপর তাঁদের সহানুভূতি প্রকাশের চেয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের চেষ্টাই বেশি।
এ কারণে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত খেদের সঙ্গে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আমাদের আস্থা নেই।’এই অনাস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। দিনে দিনে আক্রান্ত হতে হতে তাঁদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর এই হামলার দায় চাপাতে চাইছেন। তাঁদের দাবি, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বিএনপি ও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তাহলে সোজাসাপটা প্রশ্ন করতে হয়, হামলা রুখতে আপনারা কি করেছিলেন? জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কিংবা নয়াপল্টনে বিএনপির অফিসের সামনে কয়েক শ লোকের সমাবেশ হলে কয়েক হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আর কুমিল্লা, গাজীপুর, নোয়াখালী, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্বৃত্তরা কীভাবে লঙ্কাকাণ্ড ঘটাল? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কী করছিলেন?
সরকারবিরোধী দলকে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করতে পারে আর সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দির মণ্ডপে যারা হামলা করেছে, তাদের খুঁজে পায় না, এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য? সরকারি দলের নেতারা এখন ভিডিও ফুটেজ দেখে মিছিলকারীদের ধরবেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা পূজামণ্ডপগুলোতে কেন সিসিটিভি বসালেন না? সিসিটিভি বসালে ধরা পড়ত নানুয়া দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে কে অঘটন ঘটিয়েছে? ওই মন্দিরে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন। কারা বিদ্যুৎ বন্ধ করেছিল?
বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্বেগজনক খবর আসছে। শনিবার চাঁদপুরের প্রথম আলোর প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলি, তাঁকে জিজ্ঞেস করি হাজিগঞ্জের মতো এত ছোট্ট স্থানে ‘তৌহিদি জনতার’ নামে এত লোক মিছিল করে মন্দিরে হামলা করল কীভাবে? কারা ছিল এই মিছিলে? তিনি বললেন, মিছিলে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, হেফাজতের পাশাপাশি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও ছিলেন। রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, চট্টগ্রামে যারা হামলা চালিয়েছে, তাদের মধ্যে দুজন বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে সদ্য আসা নেতাও ছিলেন।
রামুতে আমরা দেখেছি, ফেসবুকে ভুয়া পোস্টকে কেন্দ্র করে সেখানে যাঁরা বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা চালিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপির, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীর লোকজনও ছিলেন। এ কারণেই পরবর্তী সময়ে মামলার সাক্ষী পাওয়া যায়নি। আক্রান্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর এত বড় তাণ্ডব ঘটে যাওয়ার পর সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যে যে আত্মোপলব্ধি জাগ্রত হওয়ার কথা ছিল, যে প্রতিবাদী ভূমিকা তাঁদের নেওয়ার কথা ছিল, বাস্তবে তার প্রচণ্ড ঘাটতি লক্ষ করছি। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, তা দায়সারা গোছের। এ কারণেই ফেনিতে আয়োজিত প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আবার সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই দুঃসাহস তারা কোথায় পায়?
বিএনপি-জামায়াতের ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতির’ বিপরীতে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনাকে এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছে যে আজ পশ্চিমবঙ্গের কট্টর সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী চিঠি লিখে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে রক্ষার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে?
অতএব, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকে বিএনপি জামায়াত কিংবা হেফাজতের দুরভিসন্ধি কিংবা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র বলে সরকার আত্মতৃপ্তি পেতে পারে, কিন্তু তাতে আক্রান্ত মানুষগুলো আশ্বস্ত হবেন না। এমনকি ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির-ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ করে দিলেও তাঁদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে না।
বিএনপি-জামায়াতের ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতির’ বিপরীতে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনাকে এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছে যে আজ ভারতে ক্ষমতাসীন সাম্প্রদায়িক দল বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের নেতা শুভেন্দু অধিকারী চিঠি লিখে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে রক্ষার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে? বাংলাদেশে কোথাও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটলে অনেকে ভারত কিংবা অন্য দেশের উদাহরণ দেন। কিন্তু তাঁরা নিজেদের ব্যর্থতার দিকে একবারও তাকান না। যেকোনো দেশের সংখ্যালঘুরা নিরাপদ থাকবেন কি না, তা অনেকাংশে নির্ভর করে সেই দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মনমানসিকতার ওপর।
সংখ্যালঘুদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা-আক্রমণেও যদি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বৃহত্তর অংশ নীরব থাকে কিংবা প্রতিবাদের কাজটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কেই করতে হয়, সে দেশে কখনোই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কিংবা সংহিত তৈরি হতে পারে না। যখন দেখি শাহবাগে তরুণেরা প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে মানববন্ধন হয়, কিংবা বিভিন্ন স্থানে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ একসঙ্গে প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হন, তখন আশা হারাতে চাই না। আমাদের রাজনীতি যত কলুষিত হোক না কেন, তরুণেরা পথ দেখাবেন।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি