২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

শ্রীলঙ্কা: সংকট উত্তরণের আরেকটি সুযোগ নষ্ট হয়ে যাবে?

বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের শুধু পদত্যাগ চান না, তাঁরা তাঁর দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহির মুখোমুখি করার দাবিও জানিয়েছেন
ছবি: রয়টার্স

শ্রীলঙ্কায় একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি হলেন ছোট একটি বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির রনিল বিক্রমাসিংহে। তাঁর চার দশকের রাজনৈতিক জীবনে বেশ কয়েকবারই এই পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। স্বাধীনতার পর থেকে দ্বীপটি সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। এর ফলে চলমান ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্যে দেশটির পার্লামেন্ট মনে করেছে, এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ডুবতে যাওয়া জাহাজকে রক্ষা করা যাবে। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা মনে করছে, এর মাধ্যমে ডুবতে থাকা টাইটানিকের ডেকের চেয়ারগুলোকেই কেবল সাজানো হলো। তারা বরং বারবার দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগ দাবি করে আসছে।

দেশটি দেউলিয়া হয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। সেখানে এখন তীব্র ঘাটতি এবং মানবিক সংকট চলছে। যেকোনো মুহূর্তে সেখানে বড় ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ তৈরি হতে পারে। কারণ, বেঁচে থাকার মৌলিক জিনিসগুলোর জন্য বেশির ভাগ মানুষকে সেখানে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে দেশটিকে স্থবির করে দিতে পারে। ৭০ বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ের অযোগ্য ও বিদ্বেষপূর্ণ শাসনকেই দায়ী করছে জনগণ। কয়েক মাস ধরে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে তিনি বধির হয়ে আছেন। ফলে সংকট আরও বেশি মরণাপন্ন হয়ে উঠছে।

গোতাবায়ের ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগ বিক্ষোভকারীদের তেমন শান্ত করতে পারেনি। পদত্যাগ করার আগমুহূর্তে পর্যন্ত তিনি যে আচরণ করলেন, সেটি সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। সরকারি বাসভবনের সামনে তিনি সমর্থকদের সমাবেশের ডাক দিয়ে গত কয়েক মাসের বিক্ষোভকে অবিশ্বাস্যভাবে প্রত্যাখ্যানই করেন। শেষমেশ বিক্ষোভকারীদের প্রবল প্রতিরোধে তাঁকে দ্বীপরাষ্ট্রটির অপর প্রান্তে একটি সামরিক ঘাঁটিতে পালিয়ে যেতে হয়। একটি আদালত এখন তাঁকে দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। মাহিন্দা বলেছেন, একটি ঐকমত্যের সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে তিনি সরে দাঁড়াচ্ছেন, কিন্তু তিনি সরকার থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় বিভেদের বীজ বুনে গেছেন।

যদিও সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী সরাসরি সহিংসতার ডাক দেননি, কিন্তু তাঁর সহযোগীরা উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালানোর জন্য কর্মীদের উসকে দেয়। বিক্ষোভকারীরা তখন ক্ষিপ্ত হয়ে পাল্টা জবাব দেয়, বাস উল্টে দেয়, রাজনৈতিক নেতাদের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেদিনের ঘটনায় নয়জন নিহত হন, আহত হন ২০০ জন। পরের দিনগুলোয় পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ ক্রমশ শান্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তা–ও দেশব্যাপী কারফিউ এবং দাঙ্গাবাজদের দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশের কারণে।

আমাদের জরুরি সহায়তা দরকার, তার মানে সেটি যথাসর্বস্বের বিনিয়মে নয়। আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের অবশ্যই বোঝা উচিত, পার্লামেন্টে মাত্র একটি আসনের অধিকারী দল থেকে একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্রুত নিয়োগের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত করা যাবে না, যেহেতু গোটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মূল কারিগরই হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট। বিশাল আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করে হলেও দেশকে টিকিয়ে রাখতে একজন সম্মানিত ও বিশ্বাসযোগ্য নেতার প্রয়োজন, অন্যথা জনগণ তা সহ্য করবে না।

বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের শুধু পদত্যাগ চান না, তাঁরা তাঁর দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহির মুখোমুখি করার দাবিও জানিয়েছেন। তাঁরা একটি নতুন শ্রীলঙ্কা চায়, আর পুরোনো কার্ডের রদবদল নয়। পুরোনো লোককে রেখেও রাজনীতিতে মৌলিক পুনর্বিন্যাস সম্ভব নয়। গোতাবায়েকে রক্ষা করার বিষয়ে রাজনীতিবিদদের সতর্ক হওয়া উচিত। নয়তো জনগণ এটাকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখবে।

প্রেসিডেন্ট গোতাবায়েকে যেতেই হবে। নয়তো পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীলতা এবং সহিংসতার দিকে চলে যাবে এবং সংকট উত্তরণের আরেকটি সুযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। রাজাপক্ষে পরিবারের আরও তিনজন মন্ত্রী ইতিমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে বিক্ষোভকারীদের কাছে এটিই প্রতীয়মান হয়েছে যে দীর্ঘদিন ধরে তারা একটি দুর্নীতিগ্রস্ত গোষ্ঠী দ্বারা শাসিত হয়েছিল এবং সেই গোষ্ঠীকে অবশ্যই ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে, তাদের একজনও ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।

তবে বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের শুধু পদত্যাগ চান না, তাঁরা তাঁর দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহির মুখোমুখি করার দাবিও জানিয়েছেন। তাঁরা একটি নতুন শ্রীলঙ্কা চায়, আর পুরোনো কার্ডের রদবদল নয়। পুরোনো লোককে রেখেও রাজনীতিতে মৌলিক পুনর্বিন্যাস সম্ভব নয়। গোতাবায়েকে রক্ষা করার বিষয়ে রাজনীতিবিদদের সতর্ক হওয়া উচিত। নয়তো জনগণ এটাকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখবে।

আরও পড়ুন

গোতাবায়ে যত বেশি সময় ক্ষমতায় থাকবেন, আইএমএফের কাছে আরও ঋণ পেতে আলোচনায় বসতে তত বিলম্ব হবে এবং এতে আরও বেশি মানুষ ক্ষুধার্ত হবে। এতে আরও বেশি বিক্ষোভ তৈরি হবে। যত বেশি অস্থিরতা তৈরি হবে, গোতাবায়ে তত বেশি সহিংসতার আশ্রয় নিতে পারেন, এমন ঝুঁকিও বাড়বে। তবে গোতাবায়ে সরকার এটি নিশ্চিত করতে পারবে না যে পুলিশ ও সেনাবাহিনী বিক্ষোভ দমনে তাদের নির্দেশ অনুসরণ করবে, কারণ পুলিশ ও সেনা সদস্যদের পরিবারগুলোও একই অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। দুর্গে ফাটল দেখা দিচ্ছে। আমরা এটিই আশা করতে পারি, অনিবার্য যে পতন দেখা যাচ্ছে, সেটি আমাদের সবাইকেই চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে না।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

ড. পাকিয়াসোথি সারাভানামুত্তু সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভস-এর নির্বাহী পরিচালক