করোনা মহামারির কারণে আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো। অমিক্রনের সংক্রমণ বাড়ছে। ফলে কিছু একটা করতে হবে সরকারকে, মানুষকে বোঝাতে হবে যে এবার তারা সিরিয়াস! এখন অন্য কিছুই যেহেতু বন্ধ করা যাবে না, মানে সব কিছুর সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য বা আর্থিক কারবার সেইসঙ্গে সিদ্ধান্তদাতাদের নানা স্বার্থ জড়িত, ফলে শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপরই চোখটা পড়ল যেন।
গত এক মাস থেকে ধীরে ধীরে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে দূরপাল্লার বাসে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনসহ ঘরের বাইরে স্বাস্থ্যবিধি পালনের কঠোর নির্দেশও জারি হয়ে গেছে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হচ্ছিল গত এক-দেড় সপ্তাহ ধরে। এ নিয়ে সুধীমহলের অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না করতে সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছিলেন। গত রোববার শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিও বললেন, ‘এখন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাভাবিক জীবন বজায় রেখে করোনার প্রকোপ মোকাবিলা করতে হবে। এটিই আমাদের সিদ্ধান্ত।’
কিন্তু আজকে আমরা দেখলাম কি? মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক নির্দেশনায় স্কুল ও কলেজ এবং সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করল। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে জানিয়ে দিল, তারাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেবে। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিত করে দিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও সশরীর ক্লাস বন্ধ রেখে অনলাইন ক্লাসের ঘোষণা দিল। কারণ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করতে হবে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের আইনে চলে, তাই এ বিষয়ে তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। যদিও আগেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাসে ফিরে গেছে। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর একে একে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করছে।
মহামারি মোকাবিলায় প্রথম ধাক্কাটা কেন বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর আসছে? ব্যাংক, অফিস-আদালত, গণপরিবহন, পর্যটনকেন্দ্র, সিনেমা হল, শপিং মল সবকিছুই খোলা। এমনকি ‘সগৌরবে’ চলছে বাণিজ্য মেলা ও বিপিএলও। সবখানে হাজার হাজার মানুষের ঢল। যেন কোথাও করোনা নেই। করোনা ঢুকে বসে আছে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ার-টেবিলের নিচে, শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ভেতর বা পরীক্ষার খাতার ভেতর!
কথা হচ্ছে, মহামারি মোকাবিলায় প্রথম ধাক্কাটা কেন বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর আসছে? ব্যাংক, অফিস-আদালত, গণপরিবহন, পর্যটনকেন্দ্র, বিনোদনকেন্দ্র, সিনেমা হল, শপিং মল সবকিছুই খোলা। এমনকি ‘সগৌরবে’ চলছে বাণিজ্য মেলা ও বিপিএলও। গ্রামে গ্রামে চলছে ইউপি নির্বাচনের মিছিল–মিটিং। সবখানে হাজার হাজার মানুষের ঢল। যেন কোথাও করোনা নেই। করোনা ঢুকে বসে আছে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ার-টেবিলের নিচে, শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ভেতর বা পরীক্ষার খাতার ভেতর! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণ হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী আমাদের জানালেন, এখন শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটছে। এটি আগে ছিল না। এটা আমলে নিতে হয়েছে। এ নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। এরপর বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়।
শিশুদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ঘটছে, সেটি অবশ্যই চিন্তার কথা। তাই বলে এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার মধ্যে আদৌ কোনো যৌক্তিকতা নেই। সবার নিশ্চয়ই মনে আছে, করোনাকালের শুরুতেও একই ভুল করেছিল সরকার। সবকিছু খোলা রেখে শুরুতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল। এরপর দেখা গেল কি, বাচ্চাকাচ্চা সবাই মিলে কক্সবাজারে ঢল নামল। এবারও কি তেমনটা ঘটবে না? এ সুযোগে সন্তানদের নিয়ে কেউ ঘুরতে চলে যাবে, কেউ বাণিজ্য মেলা চলে যাবে, কেউ শিশুপার্কে চলে যাবে। এতে করে কি শিশুরা করোনায় আক্রান্ত হবে না? যদি ঘরের মধ্যেও থাকে, তাহলে পরিবারের কেউ না কেউ অফিসে যাচ্ছে, বাজারে যাচ্ছে, শপিং মলে যাচ্ছে, আড্ডা দিতে যাচ্ছে, তাতেও কি শিশুরা নিরাপদ থাকে?
অন্য দিকে গত দুই বছরে যেসব তরুণ সেশন জটে আটকে গেল তাদের কথা ভাবুন তো একবার। এই দুই সপ্তাহের বিধিনিষেধ কত দিনে গিয়ে থামে কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনেকে বলছেন, না থামলে তো সরকারেরই লাভ। এ করে করে আরেকটা নির্বাচন চলে আসবে। নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির মধ্যে ক্ষমতার মসনদটাও আবার নিশ্চিত হয়ে গেল। আমি বাপু ছা পোষা কেরানি, সেসব নিয়ে ভাবার আমার কোনো কাজ নেই। কিন্তু গত দুই বছরে কত তরুণ–তরুণী আত্মহত্যা করল, কত কিশোরী বাল্যবিয়ের শিকার হলো, সেসবই আমার কেবল মনে পড়ছে। কত ছেলেমেয়ে শিশুশ্রমে যুক্ত হলো; রূপগঞ্জে জুস কারখানায় পুড়ে ছাই হওয়া শিশুশ্রমিকদের কথা কী করে ভুলি, স্কুল বন্ধ থাকার কারণেই তাদের এ পরিণতি হলো।
করোনা মহামারির কারণে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত বছর সেপ্টেম্বরে মাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করা হলো। স্কুলগুলোতে আগের মতো নিয়মিত ক্লাসই শুরু হয়নি। এখনো সীমিত পরিসরে ক্লাস চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবেমাত্র চাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছিল। কারও পরীক্ষা শেষ হয়েছে, কারও হয়নি। এর মধ্যে আবারও সব পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। অথচ সারা দুনিয়ার প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় খোলা। যুক্তরাজ্য, ইতালিসহ পশ্চিমা বিশ্বে যেখানে করোনা সংক্রমণের হার এখন অনেক বেশি, তারা এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখেছে। দেশে এখন ২০২০ কিংবা ২০২১ সালের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। অমিক্রনে মৃত্যুর হারও কম। আর পরিস্থিতি খারাপ হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়। গত দুই বছরেও কেন সরকারের এই বুঝটা হলো না?
আমাদের মতো অধিক জনসংখ্যার দেশে কীভাবে করোনা মোকাবিলা করতে হবে, সেটিই এখনো ঠিকঠাক বুঝতে পারছে না সরকার ও তার নীতিনির্ধারকেরা। অর্থনীতি বন্ধ করে দেওয়া মানে না খেয়ে মরা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রীতিমতো পঙ্গু করে দেওয়া। গত দুই বছরে তো সেটিরই স্বাক্ষী হলাম আমরা।
মহামারি মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর উপায় ছিল, সবাইকে টিকা দিয়ে ফেলে স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলার মধ্যে অভ্যস্ত করে তোলা। পশ্চিমা দেশগুলো এখন যা করছে। তারা বুঝে গেছে, সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে কোনোভাবেই সমাধান হবে না। কিন্তু আমরা কেন সেদিকে যাচ্ছি না। আমরা কেন আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলাম। সবেমাত্র স্কুলশিক্ষার্থীরা টিকা নিতে শুরু করেছিল, সেটি কেন পুরোপুরি শেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখলাম না।
এটা অনস্বীকার্য যে, করোনা মোকাবিলার এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে টিকা। আর আমরা দুই বছরেও দেশের সব মানুষকে দুই ডোজ টিকা দিতে পারলাম না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, এখন পর্যন্ত ১৫ কোটি ১০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ৯ কোটি ২৪ লাখ আর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে ৫ কোটি ৮০ লাখ। হাতে আরও প্রায় ৯ কোটি টিকা আছে। প্রত্যেকেই টিকা পাবেন।
এত টিকা হাতে আছে কিন্তু এখনো কেউ পেল এক ডোজ, কেউ পেল দুই ডোজ, কাউকে আবার বুস্টার ডোজও দেওয়া হচ্ছে। টিকার সঙ্কট নেই বলে বারবার বলা হচ্ছে। সে জন্য হয়তো ভারত থেকে টাকা দিয়েও টিকা না পাওয়ার কথা আমরা ভুলেই গেছি। কিন্তু বারবার সরকার এটি কেন ভুলে যাচ্ছে, গোটা জনসংখ্যার সব বয়সী মানুষকে সম্পূর্ণ টিকার আওতায় নিয়ে না আসা পর্যন্ত কোনো কিছুই বন্ধ করে আখেরে কোনো লাভ নেই। এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে আসলে করোনা মোকাবিলা হয় না।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক