রোহিঙ্গাদের জাতিগত শোধনের পক্ষে বিশ্বব্যাংক?

ভাসানচরে রোহিঙ্গা শিবিরফাইল ছবি

বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। প্রকাশিত সংবাদ, মতামত, সাক্ষাৎকার ইত্যাদির ভিত্তিতে যা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তার মোদ্দা কথাটা এ রকম—

ক. জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক শরণার্থীনীতির রূপরেখা (রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক—আরপিআরএফ) তৈরি করেছে। এর মূল সুর হচ্ছে আশ্রয় গ্রহণকারী দেশে শরণার্থীদের রেখে দেওয়া।

খ. এ রূপরেখা তৈরির কোনো পর্যায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। তৈরির পর ইআরডির মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়েছে। ভাসানচরের কাজে যুক্ততা নিয়ে দর-কষাকষির পর্যায়ে বাংলাদেশ প্রথম বিষয়টি জানতে পারে।

মিয়ানমার সেনাদের লক্ষ্য ছিল স্পষ্টতই তাদের স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বিতাড়ন এবং কখনো রাখাইনে ফেরত না নেওয়া। চার বছর ধরে তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক-ইউএনএইচসিআরের পরিকল্পনামতো যদি তাদের আশ্রয় গ্রহণকারী দেশে (অর্থাৎ বাংলাদেশে) রেখে দেওয়া যায়, তাহলে মিয়ানমার সেনাদের পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ লাভ করবে।

গ. রোহিঙ্গাদের অধিকার সুরক্ষা প্রসঙ্গে যেসব প্রস্তাব এসেছে, তাতে তাদের কমবেশি বাংলাদেশি নাগরিকদের সমান সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। ভোটাধিকার, নির্বাচন ইত্যাকার শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, এমনকি ভূমি ক্রয়ের অধিকারের প্রসঙ্গও আছে। এসব মেনে নিলে বিশ্বব্যাংক এ বাবদ বাংলাদেশকে ৫৯০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেবে।

প্রত্যাশিতভাবেই বাংলাদেশ এ উদ্ভট প্রস্তাবগুলো মেনে নেয়নি। বিশ্বব্যাংক-ইউএনএইচসিআরের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

পশ্চিমের ‘বিশেষজ্ঞরা’ উপদেশ দিতে খুব পছন্দ করেন। কিছুদিন আগে ইউরোপ থেকে কয়েকজন এসে রোহিঙ্গা শিবিরে আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য ফায়ার ইঞ্জিন কেনা এবং সেগুলো চলার সুবিধার্থে রাস্তা চওড়া করার উপদেশ দিয়ে গেছেন। স্থানীয় বাদামি মানুষের নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ এ তথ্যগুলো জানা ছিল না। ওদিকে কিন্তু দাবানলে পুড়ছে দক্ষিণ ইউরোপ। বিশ্বব্যাংক, ইউএনএইচসিআরেও এমন ‘জ্ঞানী’ ব্যক্তির অভাব নেই। একটি বিষয় তাঁদের এখনো উপলব্ধি হচ্ছে না যে বাংলাদেশ আশির দশকের ‘কদলী প্রজাতন্ত্রটি’ নয়, যাকে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলেই যেকোনো উপদেশ গেলানো যায়। তাঁদের একুশ শতকের বাস্তবতায় পদার্পণ করা প্রয়োজন।

বিশ্বব্যাংক-ইউএনএইচসিআরের বক্তব্য বেশ কটি গুরুতর প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথম প্রশ্ন, চার বছর আগে যখন গণহত্যাকারী মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের প্রায় সমুদয় জনগোষ্ঠীকে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে নিজ বাসভূম থেকে উচ্ছেদ করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়, জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল একে ‘টেক্সট বুক কেস অব এথনিক ক্লিন্সিং’ নামে অভিহিত করেছিলেন। মিয়ানমার সেনাদের লক্ষ্য ছিল স্পষ্টতই তাদের স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বিতাড়ন এবং কখনো রাখাইনে ফেরত না নেওয়া। চার বছর ধরে তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক-ইউএনএইচসিআরের পরিকল্পনামতো যদি তাদের আশ্রয় গ্রহণকারী দেশে (অর্থাৎ বাংলাদেশে) রেখে দেওয়া যায়, তাহলে মিয়ানমার সেনাদের পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ লাভ করবে। বিশ্বব্যাংক-ইউএনএইচসিআর কি এথনিক ক্লিন্সিংয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহযোগী ভূমিকা পালন করতে চায়?

দ্বিতীয় বিষয় ইউএনএইচসিআরের ভূমিকা। সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জানি, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে কাজ করছে। সংঘাতময় অনেক স্থানেই তারা যুদ্ধবাজ নেতাদের অনুরোধ–উপরোধ করে তাদের শর্ত মেনে ত্রাণ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করছে। বাংলাদেশে ঢুকলেই সেই ইউএনএইচসিআরের শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায়, উল্টো বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে বাংলাদেশকে জড়ানোর চেষ্টা করে। একটা বিষয় স্পট হওয়া প্রয়োজন, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে, ইউএনএইচসিআর নয়। ইউএনএইচসিআরের দায়িত্ব এ দুরূহ কাজে বাংলাদেশকে সহায়তা করা, মাতব্বরি করা নয়। তাদের ব্যয়িত অর্থের কতটা প্রকৃত সুবিধাভোগীরা পায় আর কতটা অযৌক্তিক উচ্চ বেতনধারী ‘বিশেষজ্ঞ’দের পেছনে ব্যয় হয়, এ নিয়েও বিতর্ক কম নেই।

তৃতীয় প্রশ্ন, বিতাড়িত রোহিঙ্গারা যাতে নিজ ভূমিতে ফেরত যেতে পারে, পশ্চিমের এসব ‘ভালো মানুষ’ গত চার বছরে এর জন্য কি কিছু করেছেন? খুঁজতে গেলে তো দেখতে পাচ্ছি না কিছুই; বরং শুরুর দিকে বাংলাদেশকে অন্ধকারে রেখে মিয়ানমারে ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআর অং সান সু চির আধা সামরিক সরকারের সঙ্গে কিছু একটা চুক্তি করেছিল।

চতুর্থ প্রশ্ন, রোহিঙ্গাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, জায়গা–জমি কেনারও অধিকার দিতে হবে। ভালো কথা, কার জমি কিনবে তারা? বাংলাদেশে কি অতিরিক্ত জমির ছড়াছড়ি? আর জমি কেনার টাকা পাবে কোথায়? মাদক, অস্ত্র আর মানব পাচার থেকে অর্জিত আয় থেকে? এ ছাড়া তো জমি কেনার মতো টাকা উপার্জনের কোনো সুযোগ নেই ক্যাম্পে বাসরত রোহিঙ্গাদের।

পঞ্চম প্রশ্ন, ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার নিয়ে জেরবার ইউএনএইচসিআর বা বিশ্বব্যাংক মিয়ানমারে রোহিঙ্গা এবং অন্যদের ভোটাধিকার রক্ষা বা উদ্ধারে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে এ পর্যন্ত? বরং জান্তাকে বেজার না করে চীনাদের পাশাপাশি পশ্চিমা কোম্পানিগুলোও যাতে সেখানে ব্যবসা করতে পারে, সেদিকেই তাদের মনোযোগ বেশি বলেই সব সময় প্রতীয়মান হয়েছে।

রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশের অন্যতম ব্যর্থতা ক্যাম্পগুলোয় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য আছে বা নিদেনপক্ষে ইতিবাচক মনোভাব আছে এমন একটি কার্যকর নেতৃত্ব গড়ে তুলতে না পারা। সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি, এ ব্যাপারে আশু দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

একটা বিষয় অবশ্য স্বীকার্য যে এত বড় একটা জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব প্রয়োজন। ক্যাম্পগুলোয় কিন্তু একধরনের নেতৃত্ব আছে, দুঃখজনকভাবে সেই নেতৃত্ব পুরোপুরি অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে, যাদের সঙ্গে স্থানীয় অপরাধীদেরও যোগসাজশ আছে। বিদেশি সংস্থা এবং এনজিওগুলো একটি বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে তুলেছে, যারা তাদের প্রতি অনুগত। এটা তারা করেছে প্রধানত সুবিধা প্রদানের ভিত্তিতে। এ ছাড়া আছে পাকিস্তানের সমর্থনভিত্তিক একরকম দূরনিয়ন্ত্রিত নেতৃত্ব, যা যেকোনো সময় বিপজ্জনক মোড় নিতে পারে। আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টির গুরুত্ব আরও বেড়েছে। ক্যাম্পের রোহিঙ্গা তরুণদের মধ্যে কট্টর মতবাদ যথেষ্ট জনপ্রিয়। তালেবানের সাফল্য সে আগুনে ঘৃতাহুতি হতে পারে। আমি মনে করি, রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশের অন্যতম ব্যর্থতা ক্যাম্পগুলোয় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য আছে বা নিদেনপক্ষে ইতিবাচক মনোভাব আছে এমন একটি কার্যকর নেতৃত্ব গড়ে তুলতে না পারা। সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি, এ ব্যাপারে আশু দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

সবশেষে, ক্যাম্পে বাসরত ১০ লাখ রোহিঙ্গা গত চার বছরে কী করেছে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে? নিজেদের লড়াইটা কিন্তু নিজেদেরই লড়তে হয়, অন্যরা শুধু সাহায্য করতে পারে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে আজ পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ গড়ে ওঠার লক্ষণ দেখা যায়নি। তারা কি অপেক্ষা করছে যে কোনো দেবদূত এসে তাদের বাসভূমে ফেরত নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে দেবে? বিভিন্ন কারণে বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুত হয়েছে যেসব গোষ্ঠী, তাদের কারও ক্ষেত্রেই কিন্তু এমনটি ঘটেনি।

মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী পুনরায় সর্বময় ক্ষমতা দখলের পর এনএলডি এবং অন্য ছোট দলগুলো মিলে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করেছে। অনেক জাতিগত গেরিলা গ্রুপও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এই সরকারকে কেউ স্বীকৃতি দেয়নি, বাংলাদেশও দেয়নি বা দেওয়া উচিত হবে না। তবে স্বীকৃতি না দিলেই যে যোগাযোগ থাকতে পারবে না, এমন তো নয়। প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষে এই সরকারের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা দরকার এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাদের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসা প্রয়োজন।

এটা ঠিক যে মিয়ানমারের সেনারা পুরো ক্ষমতা কখনোই ছাড়বে না। তবে কোনো এক সময় তারা অসামরিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অবশ্যই ক্ষমতা ভাগাভাগি করবে এবং সেখানে এই জাতীয় ঐক্যের সরকারের একটি ভূমিকা থাকবে। এই সরকার রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে, তা সে আশ্বাস যদি ঠুনকোও হয়, রোহিঙ্গাদের উচিত এগিয়ে আসা। সবাইকে সশস্ত্র ভূমিকা পালন করতে হবে এমন তো কথা নেই, কিন্তু সহযোগী ভূমিকা তো নেওয়া যায়। দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে জাতীয় ঐক্যের সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের একাংশকে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। এ ক্ষেত্রে কিছু বিনিয়োগ ভালো ফল দিতে পারে। সমস্যা সমাধানের নিশ্চয়তা দিতে পারে না কোনো কিছুই, কিন্তু ছোট বা বড় কোনো সম্ভাবনাই হাতছাড়া করার কোনো অর্থ হয় না।

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব