রাষ্ট্রের মেরামত, সামাজিক চুক্তি ও ইসির ইফতার
গত বছর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই কলেজশিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা দিন কয়েকের জন্য রাজধানীর সড়কগুলোতে শৃঙ্খলা আনার দায়িত্ব নিয়ে পোস্টার সেঁটে দিয়েছিলেন, ‘রাষ্ট্রের মেরামতের কাজ চলছে।’ তাঁরা কাজটি করেছিলেন ট্রাফিক পুলিশের সহায়তায়। আইন ভঙ্গকারী চালক ও যানবাহনকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। তাঁরা নিজেরা কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি।
গত ৯ মাসে সড়কে যে ন্যূনতম শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি, তা দুর্ঘটনার ধরন, মাত্রা ও মৃতের বর্ধিত সংখ্যা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। আগে বাস রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে খাদে পড়ত, এখন গাছের ভেতরে বাস ঢুকে যাচ্ছে। আর রাষ্ট্র মেরামতের কাজটি গত ৪৮ বছরেও কোনো সরকার করেনি। ক্ষমতাসীনেরা বরাবর পূর্বসূরিদের ওপর দোষ চাপালেও তাঁদের তৈরি জুতায়ই পা রেখে চলতে অভ্যস্ত।
এই প্রেক্ষাপটে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাষ্ট্র মেরামতের জন্য যে ১৮ দফা প্রস্তাব দিয়েছে, তা আলোচনার দাবি রাখে। গত বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কার ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এই প্রস্তাবগুলো পেশ করা হয়।
সংগঠনটি বলেছে, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের রাজনীতিতে চরম ভারসাম্যহীনতা এবং সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনকালে “রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আচরণবিধি” (তিন জোটের রূপরেখা) স্বাক্ষর ছিল এই ধরনের উদ্যোগের একটি সফল পরিণতি।’ কিন্তু সেই সফল পরিণতির পর ২৯টি বছর চলে গেলেও রাষ্ট্রকাঠামোয় কোনো পরিবর্তন আসেনি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরও নড়বড়ে হয়েছে। বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য তিন জোটের রূপরেখার আদলে একটি সমঝোতা স্মারক বা জাতীয় সনদ সই করার ওপর জোর দিয়েছে সংগঠনটি।
সুজনের ১৮ দফা নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। তবে তারা যে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা, সামাজিক সনদে সই করা এবং তরুণদের জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ‘প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার বদলে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে যতই সমৃদ্ধ হোক, আমরা বাইরের দুনিয়ায় মুখ দেখাতে পারব না। তবে এই গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা শুধু রাজনৈতিক দল নয়, জাতিধর্ম-নির্বিশেষে সব নাগরিকের মধ্যে হতে হবে। আমাদের আদি সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সামরিক শাসকেরা তাঁদের স্বার্থে সেটি পুনঃস্থাপিত করেছে এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী দল দুই পর্বে ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে পারেনি। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে সংবিধানে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা থাকতে হবে।
এ ছাড়া সুজন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতির প্রস্তাব দিয়েছে। জার্মানিসহ পৃথিবীর বহু দেশে এই ভোট ব্যবস্থা চালু আছে। আমরা যে ওয়েস্ট মিনিস্টার পদ্ধতি চালু করেছি, তাতে দলের ভোটের কোনো দাম নেই। কোনো প্রার্থী প্রতিপক্ষের চেয়ে ১ ভোট বেশি পেলেই তিনি জিতে যান। আনুপাতিক ভোটব্যবস্থা চালু হলে ছোট দলগুলোরও সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকবে। তাদের কোনো বড় দলের লেজুড় হতে হবে না। সংসদীয় রাজনীতিতে ভারসাম্য আসবে। সিপিবি, বাসদ, জনসংহতিসহ বাম দলগুলো অনেক আগেই এই প্রস্তাব দিয়েছিল।
সুজন অনতিবিলম্বে ‘সংসদ সদস্য আচরণ আইন’ ও সাংসদদের আচরণবিধি নিয়ে আইন করার কথা বলেছে। তারা সাংসদদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার কথা বলেছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে জনপ্রতিনিধিদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করার ওয়াদা করলেও তা পালন করেনি। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। বিরোধী দলে থাকতে সাংসদেরা ৭০ ধারা বাতিলের পক্ষে বলেন। আর ক্ষমতায় গেলে বেমালুম ভুলে যান। তবে সুজনের আশাবাদ যত প্রবল হোক না কেন, বর্তমানে সংসদে কার্যকর বিরোধী দল পাওয়া অনেকটা সোনার পাথরবাটি। এই সংসদে যাদের সাজানো বা নিয়ন্ত্রিত বিরোধী দল বলা হচ্ছে, তারা কেউ বিরোধী দলে বসতে চায় না। সরকারের শরিক হতে চায়।
সুজন নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে। নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের যে আট দফা তথ্য দিতে হয়, সেটি তারা রিট করে আদায় করেছে। এ ছাড়া প্রার্থীদের হলফনামা প্রকাশ করার ক্ষেত্রেও তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। সংগঠনটি নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন করার কথা বলেছে। সংবিধানে স্পষ্ট বিধান থাকা সত্ত্বেও পূর্বাপর সরকারগুলো তা অগ্রাহ্য করে এসেছে। জনপ্রশাসন থেকে নির্বাচন কমিশনে প্রেষণে নিয়োগের পরিবর্তে কমিশনের জন্য পৃথক ক্যাডার সৃষ্টি করার প্রস্তাবটিও ভালো। কিন্তু আগে প্রয়োজন মাছের মাথায় যে পচন ধরেছে, সেটি রদ করা।
এ ছাড়া সংগঠনটি যে স্বাধীন বিচার বিভাগ, সাংবিধানিক সংস্কার, গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক দল, স্বাধীন বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, প্রশাসনিক সংস্কার, বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা, শক্তিশালী নাগরিক সমাজ, স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, তার সঙ্গেও দ্বিমত করার কিছু নেই। এর অনেকগুলো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারেও লেখা আছে। ওই লেখা ও পর্যন্তই। তারা বাস্তবায়ন করে না।
আমাদের বিবেচনায় সুজনের ১৮ দফার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তরুণদের জন্য বিনিয়োগ এবং সামাজিক সনদ। বাংলাদেশে ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের কাছাকাছি। এদের কাজে লাগাতে না পারলে উন্নয়ন, সুশাসন, গণতন্ত্র ইত্যাদি ফাঁকা বুলি হয়েই থাকবে। জনসংখ্যাজনিত সুযোগ তৈরির কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। ফলে কর্মক্ষম বিপুল জনশক্তি জাতির সম্পদ না হয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। অতএব ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগানোয় তরুণদের জন্য প্রয়োজন আরও বিনিয়োগ। তাদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, সুজন নতুন সামাজিক চুক্তি প্রসঙ্গে বলেছে, রাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান আয় ও সুযোগের বৈষম্য নিরসনে একটি নতুন সামাজিক চুক্তি প্রণয়ন করা আবশ্যক। এই প্রসঙ্গে ফরাসি দার্শনিক জঁ-জাক রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্টের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, সমাজ গঠনের এমন একটা আদর্শ থাকতে হবে, যাতে সমাজভুক্ত সব ব্যক্তির জীবন ও সম্পদ সমবেত শক্তির সাহায্যে নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে এবং প্রত্যেকে পরস্পরের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় আপন আদেশই পালন করবে ও আগের মতোই স্বাধীন থাকবে। এর ফলে সামাজিক চুক্তি বিকশিত হয়। এ চুক্তি কোনো নিরঙ্কুশ শাসক তৈরি করে না। প্রত্যেক ব্যক্তি তার সব অধিকারকে সামাজিক চুক্তির দ্বারা সমষ্টির কাছে সমুদয়ভাবে সমর্পণ করে।
সুজন যখন ভবিষ্যতের নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে নানা প্রস্তাব দিচ্ছে, তখন নির্বাচন কমিশনের কাণ্ডজ্ঞান দেখে হতবাক হলাম। এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করতে পারেনি, এ কথা সবার জানা। তারা বেশির ভাগ ভোটারকে ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, সেটিও কারও অজানা নয়। তাই বলে একটি ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজনও তারা সুষ্ঠুভাবে করতে পারবে না, এ কেমন কথা!
২১ মে নির্বাচন কমিশন ইফতারের আয়োজন করেছিল, যাতে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ইসির আমন্ত্রণপত্রের ভাষা এক হলেও আমন্ত্রিতদের মধ্যে বিতরণ করা ইফতারসামগ্রী এক ছিল না। সিইসিসহ পাঁচ কমিশনার, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং ভিআইপি অতিথিদের জন্য এক ব্যবস্থা আর অন্যদের জন্য আরেক ব্যবস্থা। এটি অনেকটা রাতের ভোট দিনের ভোটের মতো। ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত এক সাংবাদিক বন্ধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন:‘এই নির্বাচন কমিশনের পক্ষেই এমনটা সম্ভব। পবিত্র রমজানের ইফতার অনুষ্ঠানে এক ছাদের নিচে বসে আজ সাধারণ খাবারের অতিরিক্ত হিসাবে নিজেরা খেলেন পোস্তা বাদামের শরবত, লাল আঙুর আর চিকেন ভুনা। কমিশন সচিবালয়ের উঁচু পদের কর্মকর্তারাও এই বিশেষ ভোগ থেকে বঞ্চিত হননি। কিন্তু সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারী আর সাংবাদিকেরা এসব খাবার পেলেন না। ভিন্ন মেন্যুতে তাঁদের জন্য বরাদ্দ ট্যাংয়ের শরবত আর মাটন তেহারির প্যাকেট। নির্বাচন কমিশনার আর কমিশনের উঁচু পদের কর্মকর্তাদের মেন্যুর সঙ্গে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাংবাদিকদের মেন্যুটা পড়লেই বৈষম্যটি বুঝতে পারবেন। সৌভাগ্যবানদের জন্য ১৪টি আইটেম আর হতভাগ্যদের জন্য ১১টি। এর মধ্যে সালাদের ক্ষেত্রেও পার্থক্য আছে। এক পক্ষের জন্য মাখা সালাদ আর অন্য পক্ষের জন্য পিস (শসার কয়েক টুকরা) সালাদ।’
নির্বাচন কমিশন ইফতার অনুষ্ঠানের নামে যা করেছে, তাতে তারা লজ্জিত হয়েছেন কি না, জানি না। তবে দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা অপমানিত বোধ করছি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও তারা যা খুশি করতে পারে না।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]