রাজনীতি কি পেশা?

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গণতন্ত্রের একটি ‘অন্য রকম’ রূপ প্রকট হচ্ছে। বিশুদ্ধবাদীরা বলছেন, এসব দেশে গণতন্ত্রের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য ক্রমে বিকৃত হচ্ছে। নাগরিকদের পরিবর্তে সেখানে একক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়কের দাপট বাড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে বিরোধী দলকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোণঠাসা করে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে খোঁড়া করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই গণতন্ত্রের রাজনীতি আসলে কেমন হওয়া উচিত? একক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়ক হওয়া কি দোষের?

প্রায় ১০০ বছর আগের কথা। ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিক। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক ম্যাক্স ওয়েবার কিছু শিক্ষার্থীর সামনে একটি আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাঁর ওই বক্তব্যের নাম বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায়—‘পেশা বা বৃত্তি হিসেবে রাজনীতি’। এতে রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতার স্বরূপ সম্পর্কে কিছু তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন তিনি। এর ১০০ বছর পূর্তি হয়েছে চলতি বছর। সম্প্রতি এ নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ম্যাক্স ওয়েবারের সেই তত্ত্ব আজকের দিনে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ, এখন রাজনৈতিক নেতারা যুক্তির পথে হাঁটার পরিবর্তে ভোটারদের মন জোগাতে অযৌক্তিক লোকরঞ্জনবাদী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন এবং সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এখন একক ক্ষমতাশালী হওয়ার প্রতি রাজনৈতিক নেতাদের আগ্রহ বেশি। পাশ্চাত্যের তুলনায় এশিয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল।

ম্যাক্স ওয়েবার বলেছিলেন, রাজনীতি একটি ভিন্ন ধরনের কার্যপ্রক্রিয়া, যার নিজস্ব নিষ্ঠুর নিয়মকানুন আছে। রাজনৈতিক দলে নেতা ও দলীয় অভিজাতদের মধ্যে একধরনের ‘ক্ষমতার দ্বন্দ্ব’ চলতে থাকে অবিরাম। যাঁরাই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন, তাঁরাই একটি ‘অতি মন্দ ঘরানার ক্ষমতার’ সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। রাজনীতিবিদদের দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো কোনো কর্তৃপক্ষ থাকে না এবং রাজনীতিতে থেকে কারও পক্ষে নিখাদ পবিত্র থাকা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, রাষ্ট্র হলো ‘বৈধ ক্ষমতা’ প্রদর্শনের একচ্ছত্র অধিকার পাওয়া একটি যন্ত্র।

রাজনীতি সম্পর্কে একটি বহুল চর্চিত বক্তব্য হচ্ছে, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।’ আর তাই মালয়েশিয়ায় অশীতিপর মাহাথির মোহাম্মদ চমক জাগিয়ে ফিরে আসেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। যে নাজিব রাজাক পরিবর্তনের ঢেউ তুলে নিজের হাতে সব ক্ষমতা নেওয়ার পাকা বন্দোবস্ত করে ফেলেছিলেন, দুর্নীতির দায়ে তাঁকে কারাগারে যেতে হয়। চীনের রাষ্ট্রযন্ত্রের বৈধ ক্ষমতার কাছে অসহায় হতে হয় উইঘুরদের। আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পড়ে শ্রীলঙ্কায় পার্লামেন্ট হয়ে যায় মল্লযুদ্ধের মঞ্চ!

‘একজন সত্যিকারের রাজনীতিবিদের কাছে রাজনীতি একটি পেশা’—শুধু এইটুকু বলেই ক্ষান্ত হননি ওয়েবার; নিখাদ রাজনীতিবিদের গুণাবলি নিয়েও আলোচনা করেছিলেন তিনি। এই গুণগুলো হলো প্যাশন বা গভীর আবেগ, দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা এবং অনুপাত-সম্পর্কিত জ্ঞান। রাজনৈতিক নেতার সামনে একটি ‘কারণ’ থাকে। তিনি শুধু ক্ষমতার জন্য বুভুক্ষু থাকবেন না। শুধু ক্ষমতার খিদে নেতাকে কোনো অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যায় না। অন্যদিকে, একজন নেতার থাকতে হবে নৈতিক মেরুদণ্ড এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা। এর সঙ্গে যখন বিচার করার যোগ্যতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা যুক্ত হবে, তখনই একজন নেতা ইতিহাসের চাকার দিক পরিবর্তনের সক্ষমতা অর্জন করবেন। মহৎ উদ্দেশে মন্দ উপায় অবলম্বনেও দ্বিধা হবে না তাঁর। নেতা হবেন বাস্তববাদী, প্রয়োজনে আপসও করবেন তিনি।

কিন্তু রাজনীতি কি আদতেই একটি পেশা? অন্তত এশিয়ার রাজনীতিবিদদের মধ্যে সেই মত জোরালো নয়। এখানকার রাজনীতিবিদেরা বলে থাকেন, স্রেফ জনগণের সেবা করতেই তাঁরা নাকি রাজনীতিতে পা রেখেছেন, অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই! কিন্তু আসলেই কি তা-ই? অন্তত বিভিন্ন সময়ে ওঠা দুর্নীতির এন্তার অভিযোগ তাতে সমর্থন জোগায় না।

এ তো গেল রাজনীতি ও রাজনীতিক নিয়ে কড়চা। গণতন্ত্র নিয়েও সমাজবিজ্ঞানী ওয়েবারের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তাঁর মতে, একটি আধুনিক দেশ যখন গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করে, তখন তার সামনে দুটি বিকল্প রাস্তা খোলা থাকে। একটি হলো আমলাতন্ত্র ও সংসদীয় চক্রের শাসন। এই পক্ষটি শুধুই নিজেদের স্বার্থে তাড়িত হয়ে কাজ করে এবং রাজনীতি থেকে সুধা সংগ্রহ করেই বাঁচে। দ্বিতীয়টি হলো নেতৃত্বনির্ভর গণতন্ত্রের শাসন (লিডারশিপ ডেমোক্রেসি)। এই প্রক্রিয়ায় একজন ক্যারিশমাটিক নেতার আবির্ভাব ঘটে, যার অঙ্গুলি হেলনে চলে পুরো রাজনৈতিক দল। এ ধরনের নেতারা বেঁচে থাকেন রাজনীতি করার জন্যই, অর্থাৎ সেটিই তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।

যে সময়ে এই তত্ত্বের অবতারণা হয়েছিল, তার কিছুদিন আগেই রাশিয়ায় ঘটে গেছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। জন্ম হয়েছিল একেবারে নতুন ঘরানার রাষ্ট্রব্যবস্থার দেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের। ইউরোপের নানা প্রান্তে তখন সমাজতন্ত্রের প্রতি একধরনের মোহময় দৃষ্টির আবির্ভাব ঘটেছিল। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক দেশগুলো তাদের সমাজে গণতন্ত্রের ভিত শক্ত করার কাজে হাত দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৩০-এর দশকের অর্থনৈতিক মন্দা সেই প্রক্রিয়ায় বাধা দিয়েছিল। এ কারণে কিছু কিছু দেশে একনায়কের আবির্ভাব ঘটে এবং শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

এই যুদ্ধের পর তো পুরো বিশ্বই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর ফের গণতন্ত্রের কথিত জয়যাত্রার শুরু। তখন অবশ্য বিশ্বের অনেক দেশে আমেরিকা প্রযোজিত ‘গণতন্ত্র’ মঞ্চস্থ হয়েছিল। আধুনিক বিশ্লেষকদের মতে, ওই সময় অধিকাংশ দেশ আলংকারিক অর্থে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেছিল। ফলে, একটি নির্দিষ্ট সময় পর সেসব দেশে ফের চলে আসে গণতন্ত্রের মুখোশ পরা একনায়ক। এ ধরনের দেশে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হিসেবে শুধুই নির্বাচন। তবে তা সুষ্ঠু ও অবাধ হয় না। খর্ব হয় বাক্‌স্বাধীনতা, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারসহ আরও অনেক কিছু। এতে করে সেসব দেশে গণতন্ত্র শুধু নামেই থাকে, কাজে না।

গণতন্ত্রে নেতার যে অবয়ব ম্যাক্স ওয়েবার এঁকেছেন, সেখানে এক সর্বগুণসম্পন্ন নেতাকে দেখানো হয়েছে। কিন্তু কোনো নেতা যখন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন, তখন তাঁর পক্ষে কি ক্ষমতার লিপ্সা থেকে দূরে থাকা সম্ভব? অন্তত গত ১০০ বছরে এমন আদর্শ দৃষ্টান্ত দেখা যায়নি। সেই নেতার পক্ষে সমানতালে নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ববান হওয়াও সম্ভব নয়। এ ছাড়া মহৎ উদ্দেশে প্রয়োজনে মন্দ উপায় অবলম্বনের বিষয়টি নিয়েও বিতর্ক হয়েছে প্রচুর। প্রশ্ন উঠেছে, একজন নেতা একই সঙ্গে বাস্তববাদী এবং সমাজ-রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম কি না?

বর্তমান বিশ্বে ম্যাক্স ওয়েবারের সংজ্ঞামাফিক ‘আংশিক নেতা’ অবশ্য ঢের পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিন, তুরস্কে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, এদিকে মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদ, ভারতে নরেন্দ্র মোদি—উদাহরণ টানলে এমন অনেক পাওয়া যাবে। এসব রাজনৈতিক নেতা ক্যারিশমার জোরে পুরো জনস্রোতকে নিজের দিকে টেনে নিতে পারেন। তাঁরা ভোটে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হন। পুরো রাজনৈতিক দলকে একা হাতে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। রাজনীতিই তাঁদের জীবনের সবকিছু। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু যখনই নৈতিক মেরুদণ্ড, ক্ষমতার প্রতি নির্লোভ মনোভাব, বিচার করার যোগ্যতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতার প্রশ্ন উঠছে, তখন কিন্তু উল্টো চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। বৈষম্যহীনতা ও স্বাধীনতার প্রসঙ্গে তাঁদের মুখে যতটা বুলি ফোটে, কাজে ততটা নয়।

যদি তা–ই হতো, তবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কলকাঠি নাড়ায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠত না। ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে উঠত না সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে অযাচিত হস্তক্ষেপের অভিযোগ। বিরোধী মত দমনের অভিযোগে মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনকে জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হতে হতো না।

তবে তাই বলে ম্যাক্স ওয়েবারের তত্ত্ব অসার হয়ে যাচ্ছে না। অনেকে বলছেন, সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন নেতাদের পরাজিত করার মন্ত্রটিও নাকি এই তত্ত্বেই লুকিয়ে আছে। কারণ, এই তত্ত্বের প্রকৃতি পুরোপুরি একনায়কসুলভ নয়, বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় থাকা সমস্যাগুলোর একটি কার্যকর সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। এ জন্য ভোটাধিকার পাওয়া নাগরিকদের গণতন্ত্রের অর্থ বুঝে দায়িত্বশীল নেতৃত্ব বাছাই করতে হবে।

১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ম্যাক্স ওয়েবার। কিন্তু তাঁর তত্ত্ব নিয়ে একবিংশ শতাব্দীতেও চলছে বিতর্ক। এবার যেন এর পুনর্জন্ম হয়েছে। হয়তো সেই বিতর্ক থেকেই পাওয়া যাবে গণতন্ত্রের নির্ভুল পথ।

অর্ণব সান্যাল: সাংবাদিক