সাত বছরের শিশুটি ভয়ে ও লজ্জায় কাউকে কিছু বলেনি। পরের দিন সন্ধ্যায় সে তার ফুফুকে ঘটনাটি বলে, ‘দোকানদার আংকেল তাকে জোর করে ব্যথা দিয়েছে।’ বলতে গেলে এটি কোনো অভিযোগ ছিল না। স্রেফ আস্থায় থাকা নিকট একজনকে শিশুটি জানাতে চেয়েছিল গা শিউরে ওঠা অভিজ্ঞতার কথা। হয়তো তার কষ্টের কথা বলে হালকা হতে চেয়েছিল। বড়রা জানেন না শিশুদের সঙ্গে এমন পরিস্থিতিতে কেমন ব্যবহার করতে হয়। এমন হলে শিশুকে তার শারীরিক আর মানসিক সুস্থতার জন্য কী পদক্ষেপ নিতে হয়। যে ঘটনার মূলে সবকিছুতেই একজন বয়স্ক মানুষ, তখন শিশুকে দোষারোপ করে তার মনের মধ্যে অপরাধবোধ জাগিয়ে তোলার কোনো যুক্তি নেই।এতে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুটির ভোগান্তি বাড়ে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে শিশুকে কোনোভাবেই দায়ী করা যাবে না। তাকে মানসিক সমর্থন করতে হবে, তার সামনে এই ঘটনা নিয়ে বারবার আলোচনা করা বা কান্নাকাটি করা যাবে না। এতে তার মানসিক সংকট চরমে পৌঁছে যায়। এই সাত বছরের শিশুটির ক্ষত্রেও তাই ঘটেছিল। শেষমেশ সে ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেই। ভাগ্য ভালো শিশুটি বেঁচে গেছে। পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে যৌন নির্যাতককে।
ছেলে শিশুরা যে সহজেই যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে এটা অনেকেরই ধারণা থাকে না। এই সুযোগটায় নেয় ছদ্মবেশী যৌন নির্যাতকেরা। আইন সালিস কেন্দ্রের করা ২০২১ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত একটা হিসাবে দেখা যায়, সে বছর মোট ৭৫ জন ছেলে শিশুকে ধর্ষণসহ যৌন হয়রানি করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করে সংখ্যাটি এর চেয়ে আরও অনেক বেশি হবে। বছর পাঁচেক আগে একটা সংগঠনের সাতক্ষীরা আর ঢাকার নয়টি স্কুলে চালানো জরিপ থেকে বলা যায়, প্রতি দশজনের একজন ছেলে যৌন নির্যাতন বা অশোভন আচরণের শিকার হয়। এই জরিপে বিভিন্ন বয়সের ও ক্লাসের মোট ১২০০ ছাত্র অংশ নিয়েছিল। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চাইল্ড এডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি’র সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ছয়জন ছেলে শিশুর মধ্যে একজন যৌন হয়রানির শিকার। মেয়ে শিশুদের মধ্যে তা প্রতি চারজনে একজন।
মেয়ে শিশুরা যেমন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাছের লোকজন যেমন আত্মীয়, শিক্ষক, পারিবারিক বন্ধু, প্রতিবেশীর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়; ছেলেদের ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটে। গত বছরের মে মাসে চট্টগ্রামে একটা শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ সে সময় জানায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি শিশুটির নিকট আত্মীয়।
একজন মা তাঁর মেয়ে সন্তানকে নিয়ে এ বিষয়ে যত উদ্বিগ্ন উৎকণ্ঠায় থাকেন ছেলেকে নিয়ে ততটায় নিরুদ্বেগে নিশ্চিন্তে থাকেন। একজন মা জানালেন, ‘ছেলেকে নিয়ে আমার অন্য ভয়; তাকে কেউ তুলে নিয়ে যাবে না তো! তাকে কেউ ফুসলিয়ে নিয়ে বা জোর করে যৌন নির্যাতন এটা কখনো হয় নাকি? আমরা শুনি মেয়েরাই কেবল এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়।’ শুধু মা বাবা কেন দেশে মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোও ছেলে শিশুদের যৌন নির্যাতন নিয়ে খুব একটা কাজ করছেন বলে মনে হয় না। তারা কিশোরী ও মেয়ে শিশুদের নিয়েই বেশি কাজ করে।
ছেলে শিশু কাদের যৌন লালসার শিকার হয়
মেয়ে শিশুরা যেমন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাছের লোকজন যেমন আত্মীয়, শিক্ষক, পারিবারিক বন্ধু, প্রতিবেশীর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়; ছেলেদের ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটে। গত বছরের মে মাসে চট্টগ্রামে একটা শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ সে সময় জানায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি শিশুটির নিকট আত্মীয়। পুলিশ ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পাওয়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কারাগারে পাঠানো হয়। অনেকে মনে করেন দরিদ্র পরিবারের ছেলে শিশুরা একটু বেশি ঝুঁকিতে থাকে। অভিভাবকদের নজরদারির বাইরে থাকলেই শিশুরা যৌন নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যে থাকে। সেখানে ধনী গরিবের বিষয়টি গৌণ। শিশু নির্যাতন বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে একজন ভারতীয় বক্তার জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনায় জানতে পারি, মা বাবার অর্থের অভাব না থাকায় দেশের অত্যন্ত সম্মানিত ও কাঙ্ক্ষিত বোর্ডিং স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। স্কুলের ছুটিতে বাড়ি এলে ব্যস্ত মা বাবা অধিকাংশ সময় তাকে গৃহভৃত্যের কাছে রেখে বাইরে যেতো। গৃহভৃত্য সেই সুযোগে নিয়মিতভাবে এই অবোধ কিশোরকে ধর্ষণ করেছে। বোর্ডিং স্কুল ছুটির সময় আর সব ছেলেরা যখন আনন্দে মেতে উঠত, কিশোরটি মনে প্রাণে চাইতো ছুটি যেন না হয়, তাকে যেন বাড়িতে যেতে না হয়।
পথ শিশুদের দিনের শেষে কোথাও বিশ্রাম নিতে হয় ঘুমাতে হয়। এসব জায়গা কবজায় রাখা বয়স্করা শিশুদের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়। বাস স্ট্যান্ড, রেল স্টেশন এবং ফেরিঘাটে শিশুদের নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে বাড়িতে, আত্মীয় বা পারিবারিক বন্ধুদের বাড়িতে, হোস্টেলে, মেসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পথে, কোনো অনুষ্ঠানে, পরিচিত পরিবেশে। পরিচিত জন ছাড়া শিশুদের যৌন হয়রানির ঘটনার নজির বলতে গেলে কম।
আইন কি ছেলে শিশুদের সুরক্ষা দেয়?
অনেক বাবা মা সন্তানের চেয়ে নির্যাতকের প্রতি অধিক আস্থা দেখিয়ে থাকে, ফলে নির্যাতিত শিশু কখনো সাহস করে মা-বাবাকে জানালেও তা নিতান্তই শিশুমনের কল্পনা বা মিথ্যা হিসেবে অভিহিত হয়। সে ক্ষেত্রে নির্যাতকের হিংস্রতা আর নির্যাতনের মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে যায়। আবার অনেক সময় শিশু ভয়ে মা-বাবাকে ঘটনাটি কখনো জানায় না। আর যদি মা-বাবা জানতে পারেন, প্রায় সকল ক্ষেত্রে সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়ে তাঁরা ঘটনা গোপন করে যান ফলে অপরাধী আইনি দণ্ডের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
অনেক অভিভাবক এমনকি আইনজ্ঞদের ধারণা, ছেলে শিশু ধর্ষণের শিকার হলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে বিচার পাওয়ার কোনো রাস্তা নাই। এটা আদতে একটা ভুল ধারণা। আইনের সংজ্ঞায় শিশু বলতে ছেলে বা মেয়ে আলাদা করা হয়নি। ১৬ বছর পর্যন্ত সব শিশুকেই বোঝানো হয়েছে। শিশু আইনেও শিশুদের কোনো লিঙ্গ ভাগ করা হয়নি। তাই ১৬ বছর পর্যন্ত কোনো ছেলে শিশু যদি ধর্ষণের শিকার হয় তাহলে ধর্ষণ মামলাই হবে।
ছেলে শিশু ধর্ষণের ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অধীনে মামলা না করে দণ্ডবিধির ৩৭৭ অধীনে মামলা করার একটা প্রবণতা আছে। এই ধারায় অস্বাভাবিক অপরাধের কথা বলা হয়েছে। সেই ধারা অনুযায়ী প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে যৌন সহবাসকে অপরাধ হিসেব গণ্য করা হয়েছে। এখানে স্বেচ্ছায় বা জোর করে কোনো পুরুষ, নারী বা জন্তুর সঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে যৌন সম্পর্কের অপরাধের সর্বনিম্ন ১০ এবং সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান আছে।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, ১৬ বছর পর্যন্ত যেকোনো লিঙ্গের শিশু ধর্ষণ বা বলাৎকারে শিকার হলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ মামলা করতে হবে। আশা করা যায় সাত বছরের শিশুটির নির্যাতকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অধীনে মামলা হবে ও বিচার হবে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত শিশুটির মানসিক সংকট দূর হবে কীভাবে? পরিবার সমাজ স্কুলে তাঁর ন্যায্য ঠাঁই দিতে হবে।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক গবেষক [email protected]