ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এফ রহমান হলের সামনে হেলমেটধারী মোটরসাইকেলচালকের হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হন নারী গণমাধ্যমকর্মী। ওই ঘটনার দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও নিপীড়ককে গ্রেপ্তার করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যে এ ঘটনা ঘটলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি। নারী নিপীড়ন কিংবা যৌন সহিংসতার ঘটনায় সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ ধরনের নিষ্ক্রিয়তা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় যে সংস্কৃতি উৎপাদন করে, সমাজের আর সব ক্ষেত্রে তার প্রভাবশালী ভূমিকা থাকে।
প্রথম আলোর খবরে জানা যায়, ভুক্তভোগী নারী ঢাকার একটি এফএম রেডিও স্টেশনের রেডিও জকি হিসেবে কাজ করেন। ধানমন্ডিতে ভাইয়ের বাসা থেকে রিকশায় পুরান ঢাকায় নিজের বাসায় যাচ্ছিলেন। তাঁর হাতে মুঠোফোন ও কানে ইয়ারফোন ছিল। তাঁর রিকশা এফ রহমান হলের সামনে এলে পেছন থেকে একটা মোটরসাইকেল আসে। হেলমেটধারী মোটরসাইকেলচালক রিকশা থামিয়ে নিপীড়ন চালায় এবং ভুক্তভোগীর জামা ছিঁড়ে ফেলে।
সহিংসতার শিকার নারী শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সেই ছেঁড়া জামার ছবি দিয়ে অনেক প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এই যে আমার ছেঁড়া জামাটা দেখতেছেন, এটাই আপনাদের বাংলাদেশ! এই দেশে মেয়েদের মলেস্ট হওয়া, হ্যারাস হওয়া, রেপ হওয়া, গালি খাওয়া স্বাভাবিক ভেবে মেনে থাকতে পারলে থাকেন, নাইলে এই রাগে-দুঃখে ট্রমাটাইজ হয়ে সুইসাইড করেন, মরে যান, যা খুশি করেন কিন্তু প্রতিরোধ কিংবা বিচারের আশা কইরেন না!’ পোশাকের কারণে নারীর ওপর সহিংসতা হয়—এমন যুক্তি অনেকেই দেখান। তবে এটা আর যুক্তিতে সীমাবদ্ধ নেই, নারীর ওপর সহিংসতার বাস্তব অস্ত্রও হয়ে উঠেছে। কিছুদিন আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী পোশাকের কারণে নরসিংদী রেলস্টেশনে সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন। এ বিষয়কে মনে করিয়ে দিয়ে ভুক্তভোগী নারী প্রশ্ন করেছেন, ‘আমার এই ড্রেসে ঠিক কী খারাপ ছিল, যার কারণে এমন ঘটনা ঘটল? পোশাকের দোষ দেওয়া মানুষগুলো সালোয়ার-কামিজে একটা মেয়েকে কী নিয়ে দোষ দেবে? আমার সঙ্গে এমনটা কেন হলো? কখনো ভাবি নাই আমার ঢাকা শহরে আমার সঙ্গেই এমন কিছু হতে পারে!...আর কারে গিয়ে বললে একটু স্বাভাবিক সিকিউরভাবে এ দেশে বাঁচতে পারব?’ (১০ জুন, ডেইলি স্টার)
প্রশ্নগুলো নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশে নারী নির্যাতন ও নারীর ওপর চলমান সহিংসতার একটা চিত্র দেয়। মূল প্রশ্নটা হলো, নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয়কে সুরক্ষিত ও স্বাধীন এলাকা বলেই ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানেই কেন একজন নারী নিরাপদে চলাচল করতে পারবেন না? এ ঘটনায় নারী অধিকারকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলেছেন। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেছেন, ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী প্রচলিত আইনে মামলা করেছেন। এখন এ বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার পুলিশের।
বিশ্ববিদ্যালয় যে সংস্কৃতি উৎপাদন করে, সমাজে নানাভাবে সেই সংস্কৃতিরই পুনরুৎপাদন হয়। এ কারণে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সংস্কৃতিকে প্রশ্ন তুলতেই হবে। উপাচার্য, প্রক্টর কিংবা অন্য কোনো প্রশাসনিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি নারীর প্রতি কতটা সংবেদনশীল, সেটা যাচাইয়ের সময় এসেছে।
প্রক্টরের এ বক্তব্য কতটা সংবেদনশীলতার প্রতিফলন? ভুক্তভোগী নারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন বলে কি প্রক্টর দায়িত্ব এড়িয়ে এ মন্তব্য করেছেন? প্রশ্ন হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হলেই কি সংবেদনশীল আচরণ করত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? প্রকৃতপক্ষে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই উপেক্ষা, নির্লিপ্ততা কিংবা নিষ্ক্রিয়তার চর্চা অনেক পুরোনো। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের প্রায় সব কটি উচ্চশিক্ষালয়ের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম খুব একটা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। এর মধ্যে অনেকগুলো সমাজে আলোচনা-প্রতিবাদের জন্ম দেয়। ১৯৯৯ সালে খ্রিষ্টীয় বর্ষবরণ উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন এক তরুণী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতার বিরুদ্ধে নারী শিক্ষার্থীদের ধর্ষণের অভিযোগে আন্দোলন হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৩ সালের ২৩ জুলাই শামসুন্নাহার হলে রাতের বেলা পুরুষ পুলিশ সদস্য গিয়ে নারী শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছিত করেছিলেন। গত কয়েক দশকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের (ছাত্রদল, ছাত্রলীগ) হামলা এবং নারী শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছনা ও নিপীড়নের অসংখ্য নজির রয়েছে। এসব ঘটনার সুস্পষ্ট তথ্য–প্রমাণ থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নিয়েছে? এই নীরবতা কি নিপীড়ক তৈরির পরিবেশকে উর্বর করে না?
ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের চর্চা চলে। কর্তৃপক্ষীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নিপীড়নের বাজে এই দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষার্থী, এমনকি নারী শিক্ষকেরাও রেহাই পান না। ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানান। কিন্তু এ রকম কয়টা অভিযোগের যথাযথ তদন্ত হয়? যাঁরা তদন্ত করেন, তাঁরাই-বা নারীর প্রতি কতটা সংবেদনশীল? বাস্তবতা হচ্ছে, খুব কম ক্ষেত্রেই যথাযথ তদন্ত হয়। আবার অভিযুক্তকে বাঁচাতে নানা কূটপদক্ষেপও নেওয়া হয়, যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন বন্ধে উচ্চ আদালতের দেওয়া বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া এ রকম একটি ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যাক।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের অভিযোগ করেছিলেন এক নারী সহকর্মী। অভিযোগের ১০ মাস পর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন নিরোধ কমিটি বলছে, ক্যাম্পাসের বাইরের ঘটনা হওয়ায় যৌন হয়রানির অভিযোগটি তারা বিবেচনাই করেনি। আর শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ নীতিমালা-২০০৮ অনুযায়ী কোনো বিষয়ে তদন্ত করতে না পারলে বা সেটি তদন্তাধীন বিষয় না হলে সাত কার্যদিবসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তা জানিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। সর্বোচ্চ ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমার নির্দেশনাও মানা হয়নি। (যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্তই করেনি কমিটি, প্রথম আলো, ১৫ জুন ২০২২)
বিশ্ববিদ্যালয় যে সংস্কৃতি উৎপাদন করে, সমাজে নানাভাবে সেই সংস্কৃতিরই পুনরুৎপাদন হয়। এ কারণে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সংস্কৃতিকে প্রশ্ন তুলতেই হবে। উপাচার্য, প্রক্টর কিংবা অন্য কোনো প্রশাসনিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি নারীর প্রতি কতটা সংবেদনশীল, সেটা যাচাইয়ের সময় এসেছে।
● মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক