আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্প বিদায় নিয়েছেন। সঙ্গে ‘ট্রাম্পিজমেরও’ বিদায়ের সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তর আলাপ হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে ‘ট্রাম্পিজম’ থেকে শিগগিরই মুক্তি মিলছে না। ট্রাম্পের ‘কুখ্যাত’ কর্মকাণ্ডকে পশ্চিমা গণমাধ্যম ‘ট্রাম্পিজম’ নামে অভিহিত করে একটি অতীব সরল পঠন প্রতিষ্ঠা করেছে। এই সরল পঠনে সবকিছুর জন্য ট্রাম্পকেই দোষারোপ করা হয়। মার্কিন রাষ্ট্র কিংবা মার্কিন রাষ্ট্রের অতীত কর্মকাণ্ডকে নয়।
আদতে ট্রাম্পকে একতরফা দোষারোপের মাধ্যমে সচেতনভাবেই অন্য সব মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘৃণিত কর্মকাণ্ডকে আড়াল করা হয়। কিন্তু ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ঘৃণা, বিদ্বেষ, বর্ণবাদ এবং দখলদারিত্ব মার্কিন রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ট্রাম্প ছিলেন শুধুই তার সর্বশেষ সংস্করণ।
ট্রাম্পের প্রত্যক্ষ উসকানিতে ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে সংঘটিত ‘বিক্ষোভ’ মার্কিন সমাজে বিদ্যমান ঘৃণা এবং ভয়ের প্রত্যক্ষ অগ্ন্যুৎপাত ছিল। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদে বিশ্বাসীরা ‘চুরি’ হয়ে যাওয়া নির্বাচনের ফলাফল বাতিল আর ট্রাম্পের সমর্থনে বিক্ষোভে নেমেছিলেন। বিক্ষোভের একপর্যায়ে ক্যাপিটল হিলে প্রবেশ করে আমেরিকা আমেরিকা বলে চিৎকার করছিলেন বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভকারীদের চোখে–মুখে ছিল ঘৃণা, বিদ্বেষ আর প্রতিবাদ।
সচেতন পাঠক নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন ঘৃণা আর বর্ণবাদের রাজনীতির গোড়া মার্কিন মুলুকে বেশ শক্ত ও পুরোনো। আধুনিক ঘৃণা, বিদ্বেষের নির্মাণের গর্ব ব্রিটিশরা কুক্ষিগত করলেও মার্কিনরা এই ঘৃণা, বিদ্বেষের রাজনীতির বর্তমান অভিভাবকত্ব নিয়ে ব্রিটিশদের মতোই গর্বিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মার্কিনরা গণতন্ত্র, আধুনিকতা, উন্নয়ন আর সেকুলারিজমের নামে সীমাহীন জাতিবাদী ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং হাঙ্গামা দুনিয়ার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে মানুষকে দ্বিধাবিভক্ত করেছে। ৬ জানুয়ারি মার্কিনদের গড়া ঘৃণা, বিদ্বেষ আর ভয়ের অভ্যন্তরীণ আগুনের একটি অংশ ক্যাপিটল হিলে প্রদর্শিত হয়েছিল।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বর্তমান মার্কিন মুলুক গঠিত হয়েছিল স্থানীয় আদিবাসীদের কচুকাটা করে। যার নেতৃত্বে ছিল শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীরা। লাখ লাখ আদিবাসীর হত্যার মধ্য দিয়ে শেতাঙ্গ হয়েছে আধুনিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন চকচকে পুঁজিবাদী রঙিন আলোয় এই হত্যাযজ্ঞের কথা চাপা পড়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের আংশিক একটি চিত্র উঠে এসেছে ব্যারি মাই হার্ট অ্যাট উন্ডেড নি: অ্যান ইন্ডিয়ান হিস্টরি অব দ্য আমেরিকান ওয়েস্ট গ্রন্থে। বর্তমান সমাজ ইসরায়েলকে দখলদার এবং হিটলারকে গণহত্যার জন্য দায়ী করে।
কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই কাজ হিটলার আর ইসরায়েলের জন্মের দুই শ বছর আগেই করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতিতে মার্কিন সমাজে বর্ণবাদ, ঘৃণা ভিন্ন বাহনে আরোহিত হয়। যার শুরু হয়েছিল ম্যাকার্থিবাদের মাধ্যমে। ম্যাকার্থিবাদ সমাজবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে ঘৃণার রাজনীতি শুরু করেছিল। কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মার্কিন মুলুকে হাজার হাজার মানুষকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ম্যাকার্থিবাদ সোভিয়েতের বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধের ভিত্তি গড়ে তোলার পাশাপাশি মার্কিন মুলুকে সমাজবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে ঘৃণাকে স্থায়ী করে দিয়েছিল।
সোভিয়েত–পরবর্তী সময়ে এই ঘৃণার নল ঘোরে মুসলমানদের ওপর। ৯/১১–এর সন্ত্রাসী হামলাকে কেন্দ্র করে পূর্বোক্ত ঘৃণায় জোয়ার শুরু হয়। ওই জোয়ার বৈধতা এনেছিল মার্কিনদের চাপিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনবরত যুদ্ধের জন্য। ম্যাকার্থিবাদ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনবরত যুদ্ধ আর ‘ট্রাম্পিজমের’ প্রধান বাহন ছিল ঘৃণা, বিদ্বেষ, বর্ণবাদ আর ভয়। তাই হালের ‘ট্রাম্পিজমকে’ শুধুই ট্রাম্পের কর্মের মধ্য আটকে রাখলে চিত্রের একটি বিশাল অংশ বাদ পড়ে যাবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময় থেকে দুনিয়ায় মার্কিনরা নিজেদের নব্য-উপনিবেশবাদ টিকিয়ে রাখতে ভয়কে ব্যবহার করে চলছে। সেই ভয় আজ মার্কিনদের নিজেদের ঘরে ফিরেছে। পোড়াচ্ছে মার্কিনদের।
এই পুরো চিত্রের একটি সামগ্রিক পঠন হতে পারে দুটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে। প্রথমত, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দ্বিতীয়ত, মার্কিন গণমাধ্যম। প্রতিটি নির্বাচনের আগে পশ্চিমা গণমাধ্যম এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যে নির্বাচনে বিজয়ের পর যেন মার্কিন প্রেসিডেন্টরা বিশ্বকে শান্তির চাদরে ঢেকে দেবেন। দুনিয়ার কোথাও মানুষ মার্কিন ড্রোন হামলার স্বীকার হবে না। বিল ক্লিনটনের কেলেঙ্কারির পর বুশ জুনিয়রকে নতুন শতাব্দীর আমেরিকার শুরু হিসেবে উপস্থাপন করেছিল মার্কিন গণমাধ্যম।
কিন্তু বুশ জুনিয়র ক্রুসেড ঘোষণা করে আফগানিস্তান এবং ইরাকের ওপর মিথ্যা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিলেন। বুশ জুনিয়রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ওবামা সিরিয়া এবং লিবিয়া জ্বালিয়েছেন। আজ আবার ট্রাম্পের বর্ণবাদী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর পশ্চিমা গণমাধ্যম বাইডেনকে শান্তির দূত আর গণত্রন্ত্রের রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করল।
কিন্তু বাইডেনের অতীত বলে অন্য কথা। ডেমোক্র্যাট হয়েও বাইডেন বুশ জুনিয়রের মিথ্যা ইরাক যুদ্ধের প্রত্যক্ষ সমর্থনকারী। ইরাক তছনছ আর ওবামার সঙ্গী হিসেবে সিরিয়া, লিবিয়ায় আগুন দেওয়ার অপরাধে বাইডেনের যুদ্ধাপরাধের বিচার হওয়া উচিত ছিল। ওয়াশিংটনের ক্ষমতাবৃত্তের প্রধান গণমাধ্যমের কল্যাণে ট্রাম্পের বিপরীতে যুদ্ধবাজ বাইডেন হয়ে উঠলেন গণতন্ত্রের রক্ষক। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের এই যুদ্ধযাত্রাকে বৈধতা দিতে গিয়ে অ–ইউরোপীয়, মধ্যপ্রাচ্যের মানুষদের বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়েছে গণমাধ্যম। রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি গণমাধ্যমের এই হিংসা, বিদ্বেষ ছড়ানোর বিশাল দায় রয়েছে। এডওয়ার্ড সাইদ বিখ্যাত কাভারিং ইসলাম গ্রন্থে যার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।
আগ্রহী পাঠক প্রশ্ন তুলতে পারেন যে ভয়–ঘৃণা আর বিদ্বেষ কি শুধুই মার্কিন দেশে। না, একদমই না। পৃথিবীর সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয়–ঘৃণা আর বিদ্বেষ কাজ করে। কিন্তু মার্কিন সমাজে ভয়, বিদ্বেষ আর বর্ণবাদ আজ মূল্যবোধের অংশীদার। বৃহৎ অর্থে পশ্চিমা সভ্যতারও। যার শুরু হয়েছিল উপনিবেশবাদের মাধ্যমে। সন্ত্রাসী কায়দায় রাষ্ট্র পরিচালনা করেও ট্রাম্প গত নির্বাচনে প্রায় দেড় কোটি ভোট বৃদ্ধি করেছেন। প্রায় প্রতি দুজন মার্কিন থেকে একজনের ভোট পেয়েছেন ট্রাম্প। সংখ্যায় যা প্রায় ৪৭ শতাংশ, প্রায় সাড়ে সাত কোটি।
কিন্তু কীভাবে এত ভোট বৃদ্ধি করলেন? সামগ্রিক অর্থে পশ্চিমা সমাজে উদারনৈতিক কিংবা সহিষ্ণুতার চর্চার প্রাধান্য থাকলে ট্রাম্পের ভোট হ্রাস হওয়ার কথা ছিল। হয়েছে উল্টো। এই ভোট বৃদ্ধির বিষয়টিকে নানাভাবে পঠনের সুযোগ আছে, কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটই তো সবকিছুই মান বিচার করে।
ঘৃণা, বিদ্বেষ আর বর্ণবাদ একটি অনিরাময় যোগ্য ক্ষত। ট্রাম্প এই ক্ষতকে বিস্তীর্ণ করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময় থেকে দুনিয়ায় মার্কিনরা নিজেদের নব্য-উপনিবেশবাদ টিকিয়ে রাখতে ভয়কে ব্যবহার করে চলছে। সেই ভয় আজ মার্কিনদের নিজেদের ঘরে ফিরেছে। পোড়াচ্ছে মার্কিনদের। ভবিষ্যতে অনবরতভাবে পোড়াতে থাকবে। কাঠামোগত কারণেই বাইডেনের পক্ষে এই ক্ষতে কার্যকরী ভেষজ সরবরাহ সম্ভব হবে না।
কারণ, বাইডেন নিজেই এই ঘৃণা ছড়ানোর কাঠামোর সঙ্গী। বাইডেনের ১৯৯৪ সালের লিখিত ‘ক্রাইম ল’ যার একটি স্পষ্ট নমুনা। বাইডেনের ব্যর্থতা শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের বর্তমান উদ্যমকে দানবে পরিণত করবে। হালের ‘ট্রাম্পিজম’ আবার নতুন নামে ফিরে আসবে। মার্কিনরা অনির্বাপণযোগ্য এক আগুনের যুগে প্রবেশ করেছে।
রাহুল আনজুম মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক।