যানজট আর আবাসন সংকট মেটাতে...
‘নাগরিক ঢাকা’ নামের একটি সংগঠন গত ২৭ জুলাই রাজধানীর কৃষিবিদ অডিটরিয়ামে ‘ঢাকা বদলাতে নাগরিক ঢাকা’ স্লোগানে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে। দেশের তরুণ যুবকেরা ঢাকা শহরের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং এই শহরকে সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য তাঁরা অঙ্গীকারবদ্ধ—এটি দেখে খুবই ভালো লাগল। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ঢাকা শহরে এখন প্রায় ২ কোটি মানুষের বাস। নগররাষ্ট্রগুলো বাদ দিলে বাংলাদেশের জনঘনত্ব পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এত লোকের বাসস্থানের ব্যবস্থা ঠিকভাবে করতে হলে প্রচুর বহুতল ভবন নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু অর্থনৈতিক সামর্থ্যের বিবেচনায় বহুতল ভবনে বাসের সুযোগ কত শতাংশ মানুষের হবে?
যানজট নিরসনের জন্য গণপরিবহনের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। নারায়ণগঞ্জ থেকে গাজীপুর পর্যন্ত যদি প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর ট্রেন চলত, তাহলে যাত্রীর অভাব হতো না। যানজট কমাতে হলে প্রাইভেট কার ও ছোট যানবাহন একদম কমিয়ে ফেলতে হবে। রেলসহ সব ধরনের বহুমাত্রিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। নগরের চারপাশের নদীগুলোকে জলপথ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। আন্তনগর যানবাহনগুলো যাতে ঢাকা শহরে প্রবেশ না করেই গন্তব্যে যেতে পারে, সে জন্য ঢাকা শহরের চারদিকে চক্রাকার প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে ঢাকা শহরের চারদিকে প্রাকৃতিকভাবে যে জলাশয় ছিল এবং নানাভাবে যার ধারাবাহিকতায় আমরা ছেদ ঘটিয়েছি, সেখানে একটি চক্রাকার জলপথ তৈরি হতে পারে। ইউরোপের প্রায় সব শহরেই এ রকম নদী কিংবা জলপথ সৌন্দর্য বর্ধন করছে এবং শহরের জলবায়ু শ্রেয়তর করাতে অবদান রাখছে। এ রকম একটি নৌপথ একাধারে যেমন রাজধানীবাসীর চিত্তবিনোদনে অবদান রাখতে পারে। একইভাবে রাজধানীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যানজট এড়িয়ে চলাতে সাহায্য করতে পারে। এ রকম চক্রাকার রাস্তা এবং নৌপথ ব্যবহার করে উত্তরা কিংবা টঙ্গীর যাত্রীরা শহরের যানজট এড়িয়ে সদরঘাট, মিরপুরের যাত্রীরা যাত্রাবাড়ী পৌঁছাতে পারে, অন্যরা কাছাকাছি চক্রাকার পথে উঠে ওই পথে সুবিধাজনক জায়গা পর্যন্ত ভ্রমণ করে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে।
ঢাকা শহরে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হবে ১৫ লাখের মতো। প্রতিদিনই এই শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে যাতায়াত করতে হয়। এই ছাত্রদের যদি ২০ শতাংশও প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত করে, তাহলে ৩ লাখ গাড়িকে সম্ভবত দুবার করে যাতায়াত করতে হয়। কখনো এই যাতায়াত উত্তরা থেকে ভিকারুননিসা, মিরপুর থেকে নটর ডেম হতে পারে। উন্নত দেশে তো বটেই, এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশেও স্কুল-কলেজে এলাকাভিত্তিক ভর্তির ব্যবস্থা রয়েছে। এ রকম একটি ব্যবস্থার সূচনা নিঃসন্দেহে যানজট হ্রাসে প্রশংসনীয় অবদান রাখবে। জার্মানির নাগরিকেরা যদি তাঁদের সন্তানদের ইচ্ছামতো যেকোনো স্কুল-কলেজে পড়াতে না পারেন এবং তা যদি সুইডেন, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডার জন্যও সত্য হয় এবং এতে এই সব উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকদের অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়, তাহলে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ নিয়ে তত মাথাব্যথা থাকার কারণ নেই। আর আমাদের অধিকার তো যত্রতত্র হরণ হচ্ছেই—যেমন আমরা রাজধানীর রাস্তায় গড়ে ৩০ কিলোমিটার বেগেও গাড়ি চালাতে পারি না। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের আগমনের ওপর নির্ভর করে ফেরি, ট্রেন কিংবা বিমানের যাত্রা।
পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের গড় দ্রুতি মাত্র ৭ কিলোমিটার। এলাকাভিত্তিক ভর্তির নিয়ম চালু করলে ভিকারুননিসা ও হলিক্রসে কিংবা নটর ডেমে তো আর অন্য কোনো দেশের নাগরিকের সন্তানেরা ভর্তি হবে না, আমাদের কোনো নাগরিকই সেই সুযোগ ভোগ করবে। আমাদের সময় এক বোর্ড থেকে অন্য বোর্ডে ভর্তি হওয়া যেত, এখন সম্ভবত যায় না। সাধারণ মানুষ সরকারের আইন পালন করে। এ ক্ষেত্রেও সরকার যদি এ রকম আইন করে যে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে বসবাসকারী নাগরিকেরাই সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তি করতে পারবে, তাহলে তা নিশ্চয়ই কার্যকর করা সম্ভব হবে। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লটারির মাধ্যমে ভর্তির একটি শ্রেয়তর নীতির সূচনা করেছে। তবে এই কাজটি মহানগরসমূহে সমন্বিতভাবে করতে হবে এবং সেখানেও বাসস্থানের নৈকট্যকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
ঢাকা শহরে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকেরা বাস করে থাকেন। দেশের উন্নয়ন অনুকূল সংস্কৃতির সূচনা এখান থেকে হওয়া বাঞ্ছনীয়। দেশের ১৭ কোটি মানুষের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে কর্মসংস্থানও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের নেতারা ‘স্বদেশি পণ্য, কিনে হও ধন্য’ স্লোগানে গোটা দেশবাসীকে উজ্জীবিত করেছেন। যে ভারত একসময় ভালো মানের ব্লেড তৈরি করতে পারত না, তারা এখন চাঁদে ও মঙ্গল গ্রহে রকেট পাঠিয়ে নাগরিকদের আত্মবিশ্বাস আকাশচুম্বী করেছে। আমরা এমনটি করতে পারিনি যথাযোগ্য আমদানি–রপ্তানি নীতিমালার অভাবে। বাংলাদেশে তৈরি কলম দিয়ে যদি ভালোভাবে লেখা না যায়, তার দুর্ভোগ কি জার্মানরা পোহাবে? এ কথাটি আমাদের তৈরি কাপড়চোপড় কিংবা ইলেকট্রনিক যন্ত্রাদির ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং নাগরিক ঢাকা ‘স্বদেশি পণ্য, কিনে হও ধন্য’—এ রকম একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। বিশেষ করে সরকারি অফিস–আদালত এবং সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এই আন্দোলনকে অগ্রে থেকে নেতৃত্বদান করতে পারেন।
সারা পৃথিবীতেই কৃচ্ছ্রসাধনের অনুশীলন চলছে। একবার সাংহাই থেকে তাইপেই যাচ্ছি। পান করার জন্য এক গ্লাস পানি চাইতেই বিমানবালা জিজ্ঞাসা করল আমার ডিসপোজেবল গ্লাসটি কই। বিমানের যাত্রীকে আরেকটি কাগজের গ্লাস পর্যন্ত দিতে চাইছে না। আরেকবার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়াতে অল্প দামি হোটেলের খোঁজে যেতে একটি কক্ষে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম চার–চারটি খাট পাতা, আবার প্রতিটির ওপর আরেকটি করে। তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশের রাজধানী ঢাকায় কী রকম হওয়া উচিত?
যে দেশে মাথাপিছু প্রাকৃতিক সম্পদ সব দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম, তাকে অবশ্যই সাশ্রয়ী হতে হবে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও সেবা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ব্যবহার ও অপচয় নিঃসন্দেহে দেশের উন্নয়নের পরিপন্থী। নাগরিক ঢাকার নাগরিকদের মধ্যে এ রকম সংস্কৃতি চালুর মাধ্যমে তা সারা দেশে বিস্তারে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করতে পারে। অবশ্য দেশে এ রকম উন্নয়ন-অনুকূল সংস্কৃতি গড়তে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা অগ্রে থেকে নেতৃত্বদান করে এমন আন্দোলনকে জোরালো করতে পারেন।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)–এর শিক্ষক ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস