আমের মৌসুম এসে গেছে। এবার তীব্র খরার কারণে দেশের অনেক স্থানেই আমের কাঙ্ক্ষিত ফলন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকায় গাছের আম ফেটে ঝরে পড়ছে, এমন খবরও পাওয়া যায়। বাজারের দিকে তাকালে মনে হয়, এখন থেকে মাস খানেক আগেই দেশে পাকা আমের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে।
গত দুই বছরের বিভিন্নমুখী প্রচারণার কারণে ১৫ মের আগে দেশের কোথাও আম বাজারে আসার কথা নয়। স্থানীয় প্রশাসনই অলিখিতভাবে আমচাষিদের এই তারিখ জানিয়ে দিয়েছে পরিণত আম বাজারজাতকরণে উদ্বুদ্ধ করার অংশ হিসেবে। বিষয়টি ইতিবাচকও বটে। এর বাইরে শুধু সাতক্ষীরা জেলায় কৃষি বিভাগ মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ২ মে থেকে আম বাজারজাতকরণের অনুমতি দিয়েছে বলে জেনেছি। তা পরিমাণে খুব বেশি নয়। কিন্তু দেশের বাজার আমে সয়লাব হয়ে যাওয়ার কারণটি কী? এসব আম আসছে কোথা থেকে? বিষয়টি যাচাই করে দেখতে গিয়ে বেরিয়ে গেল অনেক অজানা তথ্য।
চুয়াডাঙ্গার একজন অভিজ্ঞ আমচাষি ও ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন বললেন, বাজারে এখন যে আম পাওয়া যাচ্ছে, তার সবই ভারতীয়। ভারতের উত্তর প্রদেশ, কর্ণাটকসহ বিভিন্ন খরাপ্রবণ অঞ্চল থেকে এসব আম আসছে। স্থানীয়ভাবে এই আমগুলো লালমনি, পিএম, গোলাপখাস জাতের। তবে আমগুলো অবশ্যই বিভিন্ন রাসায়নিক দিয়ে পাকানো এবং পাকা অবস্থায় কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ দিন বা তারও বেশি টিকে থাকার মতো ব্যবস্থাপনা করা। রাসায়নিক প্রয়োগ করে ফসল সংগ্রহের পর টিকে থাকার সময়কাল বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ব্যবস্থা ভারতীয় ব্যবসায়ী ও প্রক্রিয়াজাতকারীদের কাছে রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে আমরা কথা বলেছি চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম গবেষণাকেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ শরফউদ্দিনের সঙ্গে। তিনিও বলেছেন, বাজারে ব্যাপকভাবে আমদানি হওয়া ভারতীয় আম কাটলে কিছু অংশ কমলা ও কিছু অংশ হলুদ রং লক্ষ করা যায়। সেগুলো অনেকটা স্বাদগন্ধবিহীন ও প্রাকৃতিক কোনো সৌরভ সেসব আমের মধ্যে নেই। শুধু বাইরের রংটিই আকর্ষণীয়। এই আমের সিংহভাগই আসছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে। সেখানে সরকারের উদ্ভিদ সংগনিরোধ (প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন)-এর দায়িত্বে নিয়োজিত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একজন উপপরিচালক আছেন। তাঁর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করি, কিন্তু ফোন বন্ধ ছিল।
যাহোক, খোঁজ নিয়ে জানতে পেলাম সোনামসজিদ স্থলবন্দরে আম পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো ব্যবস্থাই নেই। ফলে টন টন আম নির্বিঘ্নে প্রবেশ করছে। সেগুলো কী উপায়ে পাকানো ও সংরক্ষণ করা হচ্ছে, তা বের করার কোনো সক্ষমতা আমাদের নেই। অথচ এক বছর আগে ২০১৪ সালে দেশের ভেতর আমে ফরমালিন আছে—এমন অভিযোগে রাজধানীর সব প্রবেশমুখে পুলিশি অভিযান চালিয়ে শত শত টন আম ধ্বংস করা হয়েছিল। তখন যে যন্ত্র দিয়ে আম পরীক্ষা করা হয়, তা-ও সঠিক ছিল না বলে কয়েক মাস পরে আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়। শত শত আমচাষি ও আমবাগানের মালিক লাখ লাখ টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছিলেন। তাঁদের ক্ষতিপূরণ দূরের কথা সহানুভূতি জানানো, এমনকি পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনও বোধ করিনি আমরা। এখন দেশের মানুষকে আগাম আম খাওয়ানোর জন্য ভারত থেকে ক্ষতিকর আম এনে দেশি আম মৌসুমের মুখে আগেই ছাই দিয়ে রেখেছি।
এখন সারা দেশেই আম উৎপাদন হয়। গত কয়েক বছরে দেশের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে শুরু করে সবখানেই বিপুলসংখ্যক আমবাগান গড়ে উঠেছে। আম উৎপাদনে দিনের পর দিন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে আমাদের দেশ। গত বছর থেকে বাংলাদেশ আম রপ্তানি শুরু করেছে। এটি কৃষি বাণিজ্যিক খাতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা বললে ভুল হবে না। আম নিয়ে আমাদের অনেক দূর স্বপ্ন দেখার সুযোগ রয়ে গেছে। কিন্তু দেশের মধ্যেই যদি আমরা নিজেদের বাজারস্বার্থ সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের দূরের পরিকল্পনা ও স্বপ্নগুলো টিকবে কীভাবে?
বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক ডেস্কে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক ও তাৎক্ষণিক কোনো তথ্য পাইনি। জানা যায়নি প্রতিদিন কী পরিমাণ আম আমরা আমদানি করছি। এই একটি ইস্যু নিয়েই পাঁচ-সাত বছর ধরে আমাদের দেশের ফলচাষি ও উদ্যোক্তারা অভিযোগ-অনুযোগ জানিয়ে আসছেন। আমাদের দেশের ফল বাজারজাত করার মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই যেন আমরা ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করি। আমাদের দেশে এখন উচ্চমূল্যের ফল-ফসল আবাদে বহু কৃষক ও উদ্যোক্তা যুক্ত। দেশীয় বাজারে নিজেদের ফল দিয়েই মৌসুম উদ্বোধন করার স্বপ্ন দেখেন তাঁরা। বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজারের যুগে হয়তো তাঁদের সে সাধ পূরণ হওয়ার নয়, কিন্তু দেশীয় ফলের প্রতি একটু গুরুত্ব দিলে তাতে তো দেশ বহুভাবে এগিয়ে যায়, সে দিকটায় কেন খেয়াল রাখি না আমরা?
প্রশাসন জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে ১৫ মের আগে আম পাড়তে নিষেধ করেছে। তাই রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরসহ সব জেলার আমচাষিরা সেই নিয়ম মেনে নিয়েছেন। কিন্তু সরকারি নিয়ম মেনে তাঁরা বাজারে এক অসম প্রতিযোগিতার মুখেই পড়লেন। পক্ষান্তরে, আমের সূচনা-বাজারটি চলে গেল ভারতীয় আমের দখলে। বিষয়গুলোতে আমাদের গঠনমূলক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
শাইখ সিরাজ: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই।
[email protected]