রাজধানীর রমনা এলাকায় গত বুধবার পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আবু হাসান মুহাম্মাদ তারিকের বাসা থেকে একজন গৃহকর্মীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। সে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা। পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে মৌসুমী আক্তার নামের এই গৃহকর্মীর বয়স ১৪ বলে উল্লেখ করা হয়। তিন বছর আগে মৌসুমীর এক আত্মীয় তাকে ওই পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় গৃহকর্মীর কাজ দেন (৩ জুন, প্রথম আলো)।
মৌসুমী নামের এই শিশু আত্মহত্যা করেছে, নাকি অন্য কোনোভাবে তার মৃত্যু হয়েছে, সেটি তদন্তসাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে এটা নিশ্চিত যে, আইন লঙ্ঘন করে মাত্র ১১ বছর বয়সে ওই পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় শিশুটিকে গৃহকর্মী হিসেবে কাজে নেওয়া হয়েছিল। ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (সর্বশেষ সংশোধন ২০১৮)–এর ৩৪ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিশুকে নিয়োগ করা যাইবে না বা কাজ করিতে দেওয়া যাইবে না৷’ এই আইনের প্রথম অধ্যায়ে শিশুর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘শিশু অর্থ চৌদ্দ বৎসর বয়স পূর্ণ করেন নাই এমন কোনো ব্যক্তি।’ সুতরাং শ্রম আইন অনুসারে মৌসুমীকে গৃহকর্মী হিসেবে কাজে নেওয়াটা স্পষ্টতই বেআইনি এবং এ রকম একটি বেআইনি কাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহনীর দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তির নাম আসাটা উদ্বেগজনক।
শুধু রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা নয়, শিশুশ্রম নিরসনে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিসরেও নানাভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে (১৯৮৯) স্বাক্ষরকারী ও অনুসমর্থনকারী প্রথম সারির দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। এই সনদে বলা হয়েছে, স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনা করে সদস্যরাষ্ট্রগুলো শিশুশ্রমের জন্য বয়স, বিশেষ কর্মঘণ্টা ও নিয়োগে যথার্থ শর্তাবলি নির্ধারণ করবে। এতে শিশুদের সুরক্ষা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে অঙ্গীকার করা হয়েছে, যা পরোক্ষভাবে শিশুশ্রম নিরসনে সহায়তা করবে। সর্বোপরি, চলতি বছরের ২২ মার্চ আইএলও কনভেনশন-১৩৮ অনুস্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ।
এই কনভেনশন অনুযায়ীও, ১৪ বছরের নিচে শিশুদের কাজে নিয়োজিত করা যাবে না। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও শিশুশ্রম বন্ধের একটি শর্ত আছে।
গৃহকর্মী মৌসুমীর মৃত্যুর পর তার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, ‘শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেই মৌসুমীকে হত্যা করা হয়েছে। এটি স্বাভাবিক কোনো মৃত্যু নয়। দীর্ঘদিন ধরে গৃহকর্মীকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হচ্ছিল না।
এভাবে আইন পাস এবং সনদ ও কনভেনশনে স্বাক্ষর–অনুস্বাক্ষর করার পরও দেশে শিশুশ্রম নিয়ে এখনো অনেক অভিযাগ পাওয়া যায়। ২০১৬ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ১৭ লাখ শিশু রয়েছে, যাদের কাজ শিশুশ্রমের আওতায় পড়ে। এদের মধ্যে প্রায় ১৩ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিল। কোভিড মহামারির কারণে নিম্নবিত্ত এবং শ্রমজীবী পরিবারের বহু শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে এবং শিশুশ্রম আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। কোনো কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা এখন ৫০ লাখের কাছাকাছি, যা সরকারি হিসাবের প্রায় তিন গুণ। এসব পরিসংখ্যান বা হিসাব থেকে এটাই বোঝা যায়, শিশুশ্রম বন্ধে আইন থাকলেও আমাদের দেশে এগুলোর কার্যকর কোনো প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন নেই। এটা আইনের শাসনের লঙ্ঘন। কিন্তু এর সঙ্গে যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো শীর্ষ কর্তার নাম জড়িয়ে যায়, তখন সেটি আরও ভয়াবহ ব্যাপার।
মৌসুমীর মৃত্যু ও মৃণাল সেনের ‘খারিজ’
গৃহকর্মী মৌসুমীর মৃত্যুর পর তার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, ‘শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেই মৌসুমীকে হত্যা করা হয়েছে। এটি স্বাভাবিক কোনো মৃত্যু নয়। দীর্ঘদিন ধরে গৃহকর্মীকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হচ্ছিল না।…ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল প্রতিবেদন নিয়েও মৌসুমীর স্বজন ও এলাকাবাসীর মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। তাদের অভিযোগ, গৃহকর্মীর মৃত্যুর পর থেকেই নানাভাবে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে (৩ জুন, যুগান্তর)।’
মৃণাল সেনের একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্রের নাম খারিজ। একটি শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারে একজন কিশোর গৃহকর্মীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এতে দেখা যায়, গৃহকর্ত্রীর অবহেলার কারণে ওই কিশোরের মৃত্যু হলেও থানা-পুলিশ, হাসপাতালের ডাক্তার, রাজনৈতিক নেতা এবং এলাকার মাস্তানদের ‘ম্যানেজ’ করে পরিবারটি ওই মৃত্যুর দায় পুরোপুরি এড়িয়ে যায়। পরে ওই কিশোরের বাবা তাঁর ছেলের মৃত্যুর কথা জানতে পারেন। কিন্তু তিনি এতই প্রান্তিক ও অসহায় মানুষ, নিজের সন্তানের অবহেলাজনিত মৃত্যুর বিচার চাওয়ার অবস্থাও তাঁর নেই। চার দশক আগে কলকাতা শহরের প্রেক্ষাপটে নির্মিত হলেও চলচ্চিত্রটির মর্মবাণী আজও প্রাসঙ্গিক। ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালীদের অবহেলায় দুর্বল-অসহায় কারও মৃত্যু হলেও বিচার চাওয়াটা যেমন কঠিন, তেমনি বিচার পাওয়াটাও অনিশ্চিত।
মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রে পুলিশ ও অন্যদের সহযোগিতায় গৃহকর্মীর মৃত্যুর বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়। কিন্তু মৌসুমীর মৃত্যুর ঘটনায় স্বয়ং পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ও তাঁর পরিবারের নাম এসেছে। এর ফলে এই মৃত্যুর জন্য কার কতটুকু দায়, থানা–পুলিশের পক্ষে আদৌ তার নিরপেক্ষ তদন্ত করা কি সম্ভব? পিতৃহীন এই দরিদ্র মেয়েটির পরিবার কি আইনের আশ্রয় পাবে? নাকি বিচার না পাওয়ার দীর্ঘ তালিকায় আরেকটি নতুন নাম যুক্ত হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা থাকলেও এটুকু ধারণা করা যায় যে, বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতা মৃণালের চলচ্চিত্রে দেখানো গল্পের চেয়েও সম্ভবত খারাপ।
মনজুরুল ইসলাম সাংবাদিক