আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগে একটি ঘটনা জেনে আমরা খুবই অবাক হই। ঘটনাটি ঘটিয়েছেন রংপুরের কোনো এক উদ্ভাবনী দিন-শ্রমিক। কাজের জন্য তিনি যাবেন বগুড়ায়। ঘরে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়মিত টাকা পাঠানো দরকার। কেমনে পাঠাবেন? কী মনে করে বাজারে মোবাইল ফোনের রিচার্জের দোকানে গিয়ে জানলেন তাঁদের এলাকায় নিয়মিত মোবাইল রিচার্জকারীর নাম। তাঁর কাছে গিয়ে নিজের প্রস্তাব দিয়ে জানালেন, তিনি কাজের সন্ধানে বগুড়া যাচ্ছেন। নিজের মোবাইল নম্বর ওই ব্যক্তিকে দিয়ে বললেন, যখনই তাঁর রিচার্জের দরকার হবে, তাঁকে যেন ফোন করেন। তাহলে তিনি বগুড়া থেকে রিচার্জ করে দেবেন। রিচার্জের ওই টাকা যেন তিনি দিন-শ্রমিকের স্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেন। ভদ্রলোক রাজি হলেন এবং এভাবে ওই দিন-শ্রমিক মোবাইল ফোনের এক অভিনব ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের স্ত্রীকে সময়মতো টাকা পাঠাতে পারলেন।
এর এক-দুই বছর পর ডিজিটাল বাংলাদেশের সূচনালগ্নে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফরম সংগ্রহ, পূরণ ও আবার জমা দেওয়ার কষ্ট লাঘব করার বিষয়ে ভাবতে গিয়ে আমাদের এ ঘটনার কথা মনে পড়ে।
সেই সময় আমরা খেয়াল করি, ফরম পূরণ করে যেসব তথ্য শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়কে দেন, সেগুলোর সবই শিক্ষা বোর্ডের ডেটাবেইসেই আছে। এখন দরকার হলো সহজে ভর্তি পরীক্ষা ফি গ্রহণ করা। এ জন্য শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবালের বাসায় এক দিন সন্ধ্যায় আমরা কজন এ নিয়ে আলোচনা করতে বসি। সেখানেই টেলিটকের প্রতিনিধি জানালেন, টেলিটকের টকটাইম (ব্যবহারের জন্য জমা টাকা) থেকে ভর্তির ফি কেটে নেওয়া যায়! এভাবে মোবাইল ফোনে ফি গ্রহণের সম্পূর্ণ আমাদের নিজস্ব পদ্ধতি চালু হয় ২০০৯ সালে।
সেই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী এ পদ্ধতি ব্যবহার করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন প্রক্রিয়া উদ্বোধন করেন। পরের বছরে আমার কাজ ছিল এ পদ্ধতি গ্রহণ করা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পদ্ধতিটি ব্যাখ্যা করা। ২০১১ সাল নাগাদ এ পদ্ধতি একটি সর্বজনীন পদ্ধতিতে পরিণত হয়। ইতিমধ্যে সহজ অনেক পদ্ধতি চালু হলেও বিসিএস পরীক্ষাসহ বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান এই এক যুগ পুরোনো পদ্ধতিই ব্যবহার করে যাচ্ছে।
এ সময়ে দেশে দেশে মোবাইল ফোনে ব্যাংকিং সেবা নিয়ে নানা রকম আলাপ–আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে কেনিয়ার এম-পেসো পদ্ধতির কথাও আমরা জেনেছি।
শুরুর দিকে ভাবা হয়েছিল মোবাইলে আর্থিক সেবাটা হয়তো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু বিশেষ করে এই সেবাগুলোর মোবাইল অ্যাপ আসার পর থেকে পুরো ব্যাপার অন্য মাত্রা পেয়েছে। শহুরে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া হয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানসহ এখন এর বিস্তৃতি নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
২০১১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) নীতিমালা প্রণয়ন করে। এরপর প্রথম লাইসেন্স গ্রহণ করে বেসরকারি ডাচ্–বাংলা ব্যাংক, যার সেবার বর্তমান নাম রকেট। এরপরই এই লাইসেন্স পায় ব্র্যাক ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি বিকাশ। জুলাই মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় বিকাশের কার্যক্রম। সে হিসাবে এ বছর দেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের এক দশক পূর্ণ হয়ে গেল।
রকেট, বিকাশ ছাড়াও বর্তমানে বেশ কটি সেবা চালু রয়েছে এবং সেবার পরিধি ছাড়িয়ে গেছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সংখ্যার হিসাবে দেশে প্রতি দুজনের একজনের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট আছে। তাঁরা দৈনিক এক কোটির চেয়ে বেশিবার দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেন করছেন। এ সেবা এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। ঈদের দিন প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত এক খবরে দেখা যাচ্ছে, প্রবাসীরা ঈদের দিনেও সহজে দেশে টাকা পাঠাতে পেরেছেন বিকাশের মাধ্যমে।
উল্লেখ্য, এই সময় দেশের ব্যাংকগুলোর পাঁচ দিনের ঈদের ছুটি চলছে। কিন্তু বিকাশের মাধ্যমে প্রবাসীরা যে অর্থ পাঠাচ্ছেন, সেটি এজেন্টদের কাছ থেকে নগদায়ন করা যাচ্ছে। অনেক এজেন্টই এ সময় সক্রিয় রয়েছেন। তার চেয়ে বড় কথা, বিকাশে পাওয়া অর্থ দিয়ে স্বজনরা সহজে বাজার থেকে কেনাকাটার অর্থ, বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, সহজে অনলাইনে কেনাকাটা করতে পারেন। শুধু তা–ই নয়, বিকাশের কারণে এবার গরুর হাটেও নগদ অর্থ নিয়ে যেতে হয়নি। পরিশোধ করা গেছে গরুর দাম!
শুরুর দিকে ভাবা হয়েছিল মোবাইলে আর্থিক সেবাটা হয়তো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু বিশেষ করে এই সেবাগুলোর মোবাইল অ্যাপ আসার পর থেকে পুরো ব্যাপার অন্য মাত্রা পেয়েছে। শহুরে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া হয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানসহ এখন এর বিস্তৃতি নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
করোনাকাল শুরু হওয়ার পর গত বছর আমি বিকাশ অ্যাপ ইনস্টল করে নিজের বিকাশ অ্যাকাউন্ট খুলি মূলত আমার বাসায় পত্রিকা দেন যে হকার, তাঁর বিল পরিশোধ করার জন্য। যেহেতু সে সময় পত্রিকা দেওয়া বা বিল নেওয়ার জন্য হকার বাসা পর্যন্ত আসতে পারতেন না। অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের গেটে তাঁর সর্বোচ্চ আশা–যাওয়া। বিকাশ অ্যাপ ব্যবহার করে আমি ঈদের সেলামিও পাঠাতে পেরেছি দেশের নানা অঞ্চলে। আমার আশপাশে অনেকেই দেখেছি, যাঁরা বিকাশের অ্যাপ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল দেওয়া থেকে শুরু করে সুপারশপে বাজার করা, বাসার সহকারীর পরিবারে টাকা পাঠানো, রকমারি থেকে বই কেনা, জাকাতের অর্থ প্রেরণ, ফিলিস্তিন দূতাবাসকে অর্থ সাহায্য ইত্যাদি এখন এমএফএস ব্যবহারের মাধ্যমে করা সম্ভব হচ্ছে। পরপর দুই বছর বইমেলা থেকে বিকাশের মাধ্যমে বই কেনা গেছে সহজে।
অন্যদিকে, করোনাকালে শ্রমিকদের পাওনা টাকা পরিশোধ করা হয়েছে মোবাইলে। এই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া আর্থিক উপহারও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁদের এমএফএস অ্যাকাউন্টে পেয়েছেন। আগে থেকে উপবৃত্তির টাকা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাসহ সামাজিক সুরক্ষার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা এটি ব্যবহার করেছেন। এমএফএসের হাত ধরে দেশের ই-কমার্সের সম্প্রসারণ হচ্ছে দ্রুতগতিতে। প্রায় দুই হাজার ই-কমার্স সাইট ও ৫০ হাজারের বেশি ফেসবুক পেজ থেকে এখন এমএফএস ব্যবহার করে কেনাবেচা করা যায়।
সবচেয়ে বড় কথা, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ ক্রমাগত ই-বাণিজ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, যা আগামী দিনে নতুন এক বাণিজ্য ব্যবস্থার প্রধান উপকরণ হয়ে উঠবে।
২০১২ সালে সরকার আয়োজিত ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের সমাপনী অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাপী ‘সংযুক্তিই উৎপাদনশীলতা (কানেকটিভিটি ইজ প্রোডাকটিভিটির)’-এর প্রবক্তা, বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইকবাল কাদির। তাঁর বক্তব্যের মূল কথা ছিল মোবাইলকে কেন্দ্র করেই সামনের দিনের মানবিক, সামাজিক ও আর্থিক বিষয় ক্রমাগত বিকশিত হবে। নতুন প্রজন্মের হাত ধরে হবে নতুন নতুন উদ্ভাবন। সরকারি ও বেসরকারি খাতের কাজ হবে তাদের এগিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
এক দশক পূর্তিতে দেশের সব এমএফএস সেবা প্রতিষ্ঠানকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
মুনির হাসান প্রথম আলোর যুব কার্যক্রম ও অনুষ্ঠানপ্রধান