ভারত এখন স্বাধীনতার ৭৫তম বছরে। এই দীর্ঘ সময়েও ভারত বড় ধরনের অর্থনৈতিক শক্তি অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এটি দেশটির জন্য সম্ভবত সবচেয়ে বড় হতাশার বিষয়। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসে বলেছিলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে ভারত পাঁচ লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতি গড়ে তুলবে। কিন্তু তিন বছর যেতে চলল, ভারতের বর্তমান জিডিপি ৩ লাখ ১০ হাজার কোটি ডলার। এ অবস্থায় মোদি তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন—এমন কথায় বিশ্বাস করা লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
মোদি বলেছিলেন, ভারত তার ‘থ্রি ডি’ সুবিধা কাজে লাগিয়ে নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিধর করবে। তাঁর সেই ‘থ্রি ডি’ মানে হলো ‘ডি’ আদ্যাক্ষরযুক্ত তিনটি বিষয়। সেগুলো হলো, ডেমোগ্রাফিকস (জনসংখ্যা), ডেমোক্রেসি (গণতন্ত্র) এবং ডিমান্ড (চাহিদা)।
ইতিপূর্বে ভারতে যে কঠোর নিয়ন্ত্রক পরিবেশ ছিল, তা জিডিপি বৃদ্ধির হারকে ৪ শতাংশের নিচে নামিয়ে রেখেছিল। মোদি জমানায় সেই অবস্থার প্রত্যাবর্তন হয়েছে। এটিকে অনেকেই উপহাসমূলকভাবে ‘হিন্দুত্ববাদের প্রবৃদ্ধির হার’ বলে আখ্যায়িত করছেন। এটি যে শেষ পর্যন্ত বিপর্যয়কর হবে, তা মোদি সরকার বুঝলেও তারা নিজেদের বাগাড়ম্বরে বন্দী হয়ে আছে।
ভারত তার তরুণ জনসংখ্যার আধিক্যের একটি ‘জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ’ ঘরে তুলবে এমনটিই মোদি আশা করেছিলেন। তাঁর সেই আশার যৌক্তিক ভিত্তিও ছিল। যেখানে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার গড় বয়স ৩৭ বছর, জাপানে ৪৯ বছর, সেখানে ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারতের নাগরিকদের গড় বয়স ২৮ বছর। অর্থাৎ ভারতের দুই–তৃতীয়াংশের বেশি লোক পূর্ণমাত্রায় কর্মক্ষম। এতে ভারতের অর্থনীতির তীব্র গতিতে ছোটার কথা। কিন্তু তার বদলে তার অর্থনীতি হোঁচট খেয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ক্রমান্বয়ে জিডিপি নিচের দিকে নেমেছে। মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। ২০২০ সালের এপ্রিল নাগাদ বেকারত্ব ২৩.৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। ভারতে বর্তমানে ৫ কোটি ৩০ লাখ লোক বেকার। ২০০৫ সালে দেশটির শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার ছিল ৫৮ শতাংশ। ২০২১ সালে সেই হার ৪০ শতাংশে নেমেছে। এটি বিশ্বের সর্বনিম্ন স্তরগুলোর মধ্যে একটি।
২০১৪ সালে প্রথমবার সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকে মোদির অর্থনৈতিক অযোগ্যতা তার সমালোচকদের পর্যন্ত অবাক করেছে। ভারতের অন্যতম উন্নত ও শিল্পোন্নত রাজ্য গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এক দশকের বেশি সময় পার করার পর মোদি নিজেকে এমন একজন নেতা হিসেবে ভোটারদের কাছে পরিচিত করে তুলেছিলেন, যিনি গোটা ভারতের অর্থনীতির চাকাই ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম। ভারতের জনগণের একটি বিরাট অংশ মনে করেছিল, মোদি প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে প্রবেশ করা এক কোটির বেশি তরুণ এবং আধা দক্ষ ভারতীয়র আশা পূরণ করবেন। এর প্রায় আট বছর পরে, নবীন ও প্রবীণ ভারতীয়দের আশা ভেঙে পড়ে। যদিও কোভিড-১৯ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত লকডাউনের কারণে ২০২০ সালে অর্থনীতি ৭.৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল, কিন্তু মহামারি শুরু হওয়ার আগেই মোদির অর্থনৈতিক ব্যর্থতার লক্ষণরেখা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
২০১৬ সালের শেষের দিকে মোদি এক হাজার রুপির নোট বাতিল করেন এবং তার ধাক্কায় অর্থনীতিতে বিপর্যয়কর অবস্থা তৈরি হয়। ভোগ, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং রপ্তানি—অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এই মূল চালিকা শক্তিগুলো স্থবির হয়ে পড়ে এবং এর ফলে সৃষ্ট মন্দা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার পর্যাপ্ত আর্থিক প্রণোদনা দিতেও ব্যর্থ হয়। অনেক দেনদরবারের পর সরকার অবশেষে ১ ফেব্রুয়ারি পেশ করা বাজেটে সরকারি খাতে প্রণোদনা বাড়িয়েছে। নতুন বাজেটে আগামী অর্থবছরে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য ব্যয় বাড়িয়ে ৫২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার করা হয়। কিন্তু এর ফলে জিডিপির ৬.৪ শতাংশ প্রাক্কলিত রাজস্ব ঘাটতি দেখা দেবে এবং সরকারকে রেকর্ড পরিমাণ ধার করতে হবে। বাজেটে গ্রামীণ কর্মসংস্থান সুরক্ষা স্কিমের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় বরাদ্দগুলোও উপেক্ষা করা হয়েছে।
এদিকে ভারতের কৃষি খাতও সংকটে রয়ে গেছে। সংসদে বিতর্কিত কায়দায় তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন পাস করেছিল সরকার। সেই আইন বাতিল করতে টানা এক বছর কৃষকেরা আন্দোলন করার পর গত নভেম্বরে মোদি সেই আইন বাতিল করার ঘোষণা দেন। ভারতের জিডিপিতে ৩০ শতাংশ অবদান রাখা অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলো নোট বাতিলের ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খেয়েছে এবং এই ধরনের ৬০ লাখের বেশি উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারের সংস্কারের প্রয়াসও ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। শ্রম এবং ভূমি সংস্কার—সবই পরিত্যক্ত হয়েছে।
ভারতের জাতীয় পণ্য ও পরিষেবা কর ২০১৭ সালে কার্যকর হওয়ার পর সরকারের কর আদায় পদ্ধতি ব্যবসায়ীদের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। অসহায় ব্যবসায়ীদের ওপর কর অভিযান চালানোর খবর প্রতিদিনের সংবাদ শিরোনাম হয়ে উঠেছে। এটি বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের হতাশ এবং সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের নিরস্ত করছে। সরকার ভারতে আমদানি করা আরও প্রায় তিন হাজার রকমের পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়িয়েছেন। এতে ৭০ শতাংশ আমদানি পণ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
ইতিপূর্বে ভারতে যে কঠোর নিয়ন্ত্রক পরিবেশ ছিল, তা জিডিপি বৃদ্ধির হারকে ৪ শতাংশের নিচে নামিয়ে রেখেছিল। মোদি জমানায় সেই অবস্থার প্রত্যাবর্তন হয়েছে। এটিকে অনেকেই উপহাসমূলকভাবে ‘হিন্দুত্ববাদের প্রবৃদ্ধির হার’ বলে আখ্যায়িত করছেন। এটি যে শেষ পর্যন্ত বিপর্যয়কর হবে, তা মোদি সরকার বুঝলেও তারা নিজেদের বাগাড়ম্বরে বন্দী হয়ে আছে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় সরকার ছোট আকারের কল্যাণমূলক কিছু কর্মসূচির মাধ্যমে গুরুতর অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ঠেকিয়ে রেখেছে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের সমর্থন পাওয়ার জন্য তারা ভারতের সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলিমদের লক্ষ্য করে মেরুকরণের বক্তৃতা করছে। এ ধরনের কৌশল দেশকে বিভক্ত করছে এবং দীর্ঘ মেয়াদে তার প্রভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয় আসতে পারে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● শশী থারুর জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী