২০১৬ সাল। আমি তখন প্রথম আলোয় কর্মরত। ২৩ এপ্রিল সকাল ১০টায় সম্পাদক মতিউর রহমান বললেন, 'আবেদ ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নিতে যাব। চলো। রেকর্ডার সঙ্গে নাও।' আমি একটু অপ্রস্তুত। কিন্তু অবাক হইনি। কারণ, আমি জানতাম, কদিন থেকে সাক্ষাৎকার গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে। বেলা ১১টায় মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে পৌঁছাতে হবে। ডিজিটাল রেকর্ডার নিয়ে আমি প্রস্তুত। আমাদের সঙ্গে প্রথম আলোর প্রধান আলোকচিত্রী জিয়া ইসলাম। তিনি ক্যামেরার পাশাপাশি এবিসি রেডিও থেকে নিয়েছেন এক বিশেষ রেকর্ডার। ২৭ এপ্রিল স্যার ফজলে হাসানের ৮০তম জন্মবার্ষিকী। দেশের প্রধান গণমাধ্যমগুলোর কর্তাব্যক্তিরা যোগাযোগ করেছেন সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। আবেদ স্যার সম্ভবত বলেছিলেন, এ উপলক্ষে কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গেই কথা বলতে চান না। কারণ, তিনি জন্মদিন নিয়ে হইচই পছন্দ করেন না। তবে মতি ভাই তাঁকে রাজি করিয়েছিলেন।
নির্দিষ্ট সময়ের ১০ মিনিট আগে আমরা পৌঁছে যাই। ঠিক ১১টায় আসেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। শুরুর প্রশ্নেই তিনি ব্যাখ্যা করলেন, কেন নৌ-স্থাপত্য বাদ দিয়ে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দানের জন্য কীভাবে করাচি থেকে আফগানিস্তান হয়ে লন্ডন পৌঁছালেন, ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার আগে নিঃস্ব মানুষের আর্থিক সহায়তার জন্য লন্ডনের বাড়ি বিক্রি করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন, কেন কীভাবে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে গেলেন। সাক্ষাৎপর্ব চলছিল আলাপের মতো করে। ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার গল্প, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গল্প, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জীবনসংগ্রামের গল্প, সহায়-সম্বলহীন উদ্বাস্তু মানুষের ঘরে ফেরার গল্প যে একই সূত্রে গাঁথা!
গল্পগুলো কিছুটা জানা ছিল, কিছু ক্ষেত্রে অস্পষ্টতাও ছিল। জানতাম না, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে বন্ধুদের নিয়ে সমমনা বিদেশিদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য গঠন করেন 'অ্যাকশন বাংলাদেশ' এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সহায়তার জন্য গড়ে তোলেন 'হেল্প বাংলাদেশ' নামের দুটি পৃথক সংগঠন। দেশ স্বাধীন হলো। বঙ্গবন্ধু লন্ডনে গেলেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে। তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন। তাঁরা খুব আনন্দিত, নেতা মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু দেশের সহায়-সম্বলহীন সাধারণ মানুষগুলো খাবে কী, পরবে কী? নিঃস্ব মানুষগুলো মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করবে কোথা থেকে?
সেই ভাবনা থেকেই স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী সময়ে দেশের সাধারণ বা প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা। কেবল তাদের জীবনমান উন্নত করার উদ্দেশ্যে একজন পাশ্চাত্য শিক্ষিত মানুষ যুক্তরাজ্যের নিশ্চিত ও বিলাসবহুল জীবন ফেলে চলে যে আসতে পারেন, তার দৃষ্টান্ত বিরল। সদ্য স্বাধীন, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত একটি দেশে এসে কাজ করার মতো এমন ঝুঁকি নেওয়া খুব বেশি মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে গল্প এখন সবার জানা। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের পেছনের গল্পগুলো যখন একে একে তাঁর মুখ থেকে শুনছিলাম, মনে হচ্ছিল, শান্ত-সৌম্য, অত্যন্ত স্থিতধী, বিচক্ষণ ও সৃষ্টিশীল মানুষটিকে একটুও স্মৃতি হাতড়াতে হচ্ছে না। অনর্গল বলে যাচ্ছেন।
তাঁর বলার ধরন এমনই প্রাণবন্ত ছিল, তিনি তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞের বিচিত্র অভিজ্ঞতার পাতা যখন উল্টাচ্ছিলেন, যেন কোনো কবি কিংবা গল্পকার গল্প বলে যাচ্ছেন আর স্বয়ংক্রিয়ভাবে রচিত হচ্ছে কিছু চিত্রকল্প। যেন আমিও দেখতে পাচ্ছি শৈল্পিক ক্যানভাসে আঁকা চিত্রগুলো। তিনি যখন শাল্লা গ্রামের দরিদ্র মানুষ ও তাদের ঘরবাড়ির বর্ণনা দিচ্ছিলেন, মানুষের দুঃখ-কষ্ট এবং তাদের সঙ্গে কথা বলার নানা অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছিলেন, যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছিল হতদরিদ্র সেই মানুষগুলোর মুখ। শাল্লা গ্রামকে দিয়ে তিনি মূলত গোটা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। কতটা দেশপ্রেমিক হলে, কতটা মানবতাবাদী হলে সুনিশ্চিত জীবনকে ঠেলে দিয়ে ভাবতে পারেন, এক কোটির বেশি মানুষ ভারত থেকে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসছে, তাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা কী হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাঁর বক্তব্য, 'তাদের এভাবে ফেলে আমি বিদেশ-বিভুঁইয়ে সুখে-শান্তিতে দিন কাটাব, এটা কোনো কাজের কথা নয়।'
বাংলাদেশ তখন ছিল শীর্ষ দরিদ্রতম দেশের তালিকায় দ্বিতীয়। দেশের সাধারণ মানুষের জন্য একেকটা প্রকল্প হাতে নেন আর সেই প্রকল্প বাস্তবায়নের সুবিধার্থে আরেকটা প্রকল্প সামনে আনেন। এভাবে সাধারণ মানুষকে তিনি সম্পৃক্ত করেছেন তাঁর উন্নয়ন কার্যক্রমে। তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন, কিছুদিন ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে ফিরে যাবেন লন্ডনে। কিন্তু তা হয়নি। তিনি ধাপে ধাপে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, মানুষকে ক্ষমতায়িত করার চেষ্টা করেছেন, একের পর এক প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। তাঁর একটি কথা প্রায়ই মনে পড়ে, 'মানুষ দরিদ্র। কারণ তারা ক্ষমতাহীন।' তাই হয়তো প্রান্তিক মানুষকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে কিছু কাজে উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন, যা দ্বারা কেবল প্রান্তিক বা সুবিধাবঞ্চিত মানুষই সুফল পেয়েছে, তা নয়। সমাজের সব শ্রেণির মানুষই সেসবের মধ্য দিয়ে উপকৃত হয়েছে। তিনি অনেক প্রসঙ্গের মধ্যে বলছিলেন খাবার স্যালাইন বানানোর পদ্ধতির কথা। তাঁর বলার মধ্যে আমি আমার শৈশবের স্মৃতি খুঁজে পাচ্ছিলাম। আমরা তখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র।
একদিন স্কুলে কয়েকজনের একটি দল এসে শিখিয়ে দিল, কীভাবে খাবার স্যালাইন বানাতে হয়, কখন তা খেতে হয়। মনে আছে, সেদিন আমরা বন্ধুরা সবাই মিলে নামতার মতো 'এক চিমটি লবণ, এক মুঠ গুড়, আধা সের পানি' মুখস্থ বলতে বলতে বাড়িতে এসেছিলাম। এসেই আম্মাকে বলেছিলাম। পরে শুনি, একটি দল আমাদের বাড়িতেও এসেছিল। সেই সময় প্রতিবছর সারা দেশের মতো আমাদের আশপাশের গ্রামেও কলেরায় অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করত। সাধারণ মানুষের মধ্যে তখন ধারণা ছিল, পানি বেশি খেলে রোগটি বাড়ে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সারা বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে সচেতনতার এই প্রয়াস যে ব্র্যাক চালিয়েছিল, তা প্রথম শুনলাম তাঁর মুখে। এর আগে কখনো কারও কাছ থেকে শুনিনি, খাবার স্যালাইন বানানো শেখানোর ব্যাপারে ব্র্যাকের ক্যাম্পেইনের অবদান এতটা। আমি সেদিনই অনুধাবন করলাম, ব্র্যাক তো কেবল এনজিও না, ব্র্যাক এমন একটি প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশের এমন কোনো মানুষ নেই, যিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড দ্বারা ন্যূনতম সুফল ভোগ না করেছে। স্যার আবেদ জানালেন, মাতৃমৃত্যু-শিশুমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রেও রয়েছে ব্র্যাকের অসামান্য ভূমিকা। তিনি তথ্য দিলেন, মাতৃমৃত্যুর হার লাখে ছিল ৮০০। এখন ১৭৫-এ। এই হার ৩০ জনে নামিয়ে আনতে কী করতে হবে, সেই উদ্যোগ গ্রহণ করছে ব্র্যাক।
শুধু আর্থসামাজিক খাতে নয়, কৃষি খাতেও ব্র্যাকের অবদান অসামান্য। বিদেশ থেকে একইভাবে উন্নতমানের ফসলের বীজের আমদানি করেছে ব্র্যাক। এর সুফল পেয়েছে দেশের প্রত্যেকটি মানুষ। ভুট্টা বাংলাদেশে প্রথম আমদানি করে ব্র্যাক। তা চাষ করতে কৃষককে উদ্বুদ্ধও করা হয় ব্র্যাকের পক্ষ থেকে। শুধু আমদানি বা উৎপাদন নয়, সেগুলো বাজারজাত করার নিশ্চয়তাও দিয়েছে ব্র্যাক। দেশের পোলট্রি মুরগির আমদানিতে রয়েছে ব্র্যাকের ভূমিকা। বলা যায়, ভুট্টাকে কেন্দ্র করেই পোলট্রিশিল্প গড়ে ওঠে। প্রান্তিক মানুষের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ থেকে সবজি চাষ; সবজি চাষ থেকে মুরগি পালন একসঙ্গে চালাতে গ্রামের নারীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে। মুরগি রোগমুক্ত করার জন্য ব্র্যাক সরকারকে ভ্যাকসিনের প্রয়োজনের কথা জানায়। এসব কথা যখন তিনি বলছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে আমার স্মৃতি সজাগ হয়ে গেল। মনে পড়ল, সেই সময় যে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গ্রামের নারীরা সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মুরগিকে ভ্যাকসিন দিয়ে যেতেন। খুব ভোরে তাঁরা আসতেন ঘর থেকে মুরগি বের হওয়ার আগেই। আমার শৈশবের আরেকটি স্মৃতিও জাগ্রত হয়ে ওঠে, যখন শুনি বাংলাদেশে আমাদের অঞ্চলে রাস্তার দুই ধারে যে রেশমের গাছ লাগানো হয়েছিল, সেটাও করেছিল ব্র্যাকই। প্রতি ১০০ গাছের যত্নের জন্য একজন নারীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ব্র্যাকের এই প্রচেষ্টা অবশ্য খুব বেশি সাফল্য পায়নি ১৯৯৪ সালের বন্যার কারণে। কিন্তু রাস্তার দুধারে নতুন ধরনের সেই গাছ, মাঝখানে সামান্য জেগে থাকা সড়ক ধরে নানাবাড়ি যাওয়ার স্মৃতি আমার এখনো মনে পড়ে।
বিশ্বের লাখো মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়তাকারী, একেবারে নিরহংকারী, সাদামাটা জীবনের অধিকারী স্যার আবেদের কাছ থেকে অত্যন্ত অনুপ্রেরণামূলক স্মৃতি চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে। এমন একজন গুণী মানুষের স্মরণেই কেবল উচ্চারণ করা যায়: 'তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ,/ তাই তব জীবনের রথ/ পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার/ বারম্বার।' আজ ৮৪তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্ব এখন গভীর এক সংকটে পতিত। তিনি চলে গেছেন গত বছর ২০ ডিসেম্বর। থাকলে হয়তো মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় নতুন কোনো ভাবনা সামনে নিয়ে আসতেন। অবশ্য তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাক এবং তাঁর যোগ্য উত্তরসূরিরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন স্বল্প আয়ের 'শূন্য থালা' বা 'শূন্য পেটের' মানুষগুলোর জন্য।
ইসমাইল সাদী: শিক্ষক ও লেখক।