মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গভীর আবেগের বিষয়। কিন্তু এ আবেগের বাইরে মুক্তিযুদ্ধকে আমরা কতটা প্রাসঙ্গিক রেখেছি, সেটা এক বড় প্রশ্ন। এটা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। প্রাণান্তকর যুদ্ধে ব্যাপক রক্তক্ষয় ও বিপুলসংখ্যক মানুষের দুঃখ-দুর্ভোগের বিনিময়ে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অর্জনের অভিজ্ঞতা যেকোনো জাতির জন্য বিরাট তাৎপর্য বহন করে। এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ আজও অবশ্যই প্রাসঙ্গিক। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এর প্রাসঙ্গিকতা বরং আরও বেশি।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গগুলো আসলে কী?
এ প্রশ্নের উত্তরে চলে আসবে বহু ব্যবহারে জীর্ণ করে তোলা কতকগুলো শব্দ ও শব্দবন্ধ; আত্মপ্রবঞ্চকের বাগাড়ম্বরে সেগুলোর অর্থই হারিয়ে গেছে। আজ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ সম্ভবত অর্থহীন শব্দবন্ধে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক স্বাধীনতা—এগুলো আজ লাঞ্ছিত শব্দ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার ভোটাররা পাকিস্তানি সামরিক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পেরেছিল। সেই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানানোর চূড়ান্ত ফল হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাঙালির রাজনৈতিক অধিকার মেনে নিতে অস্বীকৃতির ফল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আর সেই যুদ্ধের ফসল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সেই স্বাধীন দেশে গত ৫০ বছরে আমরা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার কী শোচনীয় দুর্দশাই না করেছি। আমাদের স্বাধীন দেশের ‘স্বাধীন’ নির্বাচন কমিশন আজ পরিণত হয়েছে এক জাতীয় লজ্জায়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সে রকম নির্বাচনও যে সম্ভব, তা কি মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিল?
মুক্তিযুদ্ধের মূল স্বপ্ন গণতন্ত্র, গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ নির্বাচন; সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব ন্যায্য ও শোভনীয় পন্থা যে আমরা স্বাধীনতা অর্জনের পাঁচ দশকের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলব, তা কি আমরা জানতাম! নাকি আমরা আসলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ন্যায্য ও সভ্য ব্যবস্থা ঠিকমতো গড়ে তুলতেই পারিনি? আমরা ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারিনি বলে একসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মতো একটি বিকল্প পন্থা চালু করেছিলাম। কিন্তু দুটি নির্বাচনের পরেই সেই ব্যবস্থাটিও নষ্ট করতে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছি এবং শেষ পর্যন্ত সেটি বাতিল করে দিয়েছি। এই যে ছলে-বলে-কৌশলে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া এবং সেই ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার জন্য নতুন নতুন অপকৌশল আবিষ্কার করা—এই কি ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার? এই জন্য এত রক্তক্ষয়?
আর আমাদের স্বাধীন দেশের সংবিধানপ্রদত্ত বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা গত ৫০ বছরে ধারাবাহিকভাবে এতটাই ক্ষয়ে গেছে যে ক্ষমতাধরের রাজনৈতিক নীতিহীনতা ও জবরদস্তির কথা বলতে ও লিখতে গিয়ে ভয়ে-শঙ্কায় আমাদের বুক কাঁপে। কথা বলার জন্য, লেখার জন্য, ছবি আঁকার জন্য লেখক মুশতাক আহমেদ কিংবা কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের মতো মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশে—এটা কি মুক্তিযুদ্ধের সময় কল্পনীয় ছিল?
বিশেষ ক্ষমতা আইন, ইনডেমনিটি আইন, সন্ত্রাস দমন আইন, জননিরাপত্তা আইন, দ্রুত বিচার আইন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ গত ৫০ বছরে যত গণবিরোধী কালাকানুন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়েছে, সেগুলোর সবই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও নাগরিক ভিন্নমত দমন এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করার জন্য যত রকমের কারসাজি ও জবরদস্তিমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে সেগুলোর সবই খুব প্রাসঙ্গিক। কারণ, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার—এককথায় স্বাধীন-সার্বভৌম সোনার বাংলার স্বপ্নগুলো যেসব শব্দ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল, আজ যেন সেগুলো থেকে কোনো অর্থময় ধ্বনি উৎপন্ন হয় না।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এক যুগের বেশি সময় ধরে এই দল দেশ পরিচালনা করছে। এ দলের নেতৃত্বের প্রকাশ্য অঙ্গীকার হলো ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ঊর্ধ্বে তুলে রাখা। এই চেতনার অবমাননা প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এক বা একাধিক ধারা তৈরি করে রাখা হয়েছে। এই আইনের বিরোধিতাকারীরা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ একটি ব্যাপক বিস্তৃত বিষয়, যা ওই আইনটিতে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যাপক বিস্তৃত বিষয়, যার মধ্যে স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, আইনের শাসনভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদমুক্ত, বৈষম্যহীন বা সমতাভিত্তিক, শোষণহীন, সুখী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের সব স্বপ্ন নিহিত আছে।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল ন্যায়যুদ্ধ, কারণ আমরা পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায়-অবিচারের শিকার হয়ে ছিলাম ২৩ বছর; সেই সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধেই ছিল আমাদের যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ ছিল সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। কারণ, শাসকদের অন্যায়-অবিচার থেকে চূড়ান্তভাবে মুক্তি অর্জনের স্বপ্ন ছিল পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণের; প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সর্বপ্রকারে যুদ্ধটা লড়েছিল জনগণ।
সেই যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি আজ স্বাধীন বাংলাদেশের শাসক দল। আওয়ামী লীগের নেতারা এখন ভেবে দেখুন, আনুষ্ঠানিকভাবে নয়, আন্তরিকভাবে বুঝে দেখুন, মুক্তিযুদ্ধ কেন শুধুই প্রাসঙ্গিক বিষয় নয়; বরং কেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও অঙ্গীকারের দায় থেকে নিস্তার লাভের কোনো পথ নেই। লাখ লাখ শহীদের রক্তের ঋণ কেন এইভাবে শোধ হওয়ার নয়, যেভাবে ৫০ বছর ধরে চলছে বাংলাদেশ।
মশিউল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক