র্যাবের সদস্যদের একাংশের বিচারবহির্ভূত কার্যক্রম সম্পর্কে অভিযোগ নতুন নয়। কিছু অভিযোগ ক্ষেত্রবিশেষে আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের একটি ঘটনায় দণ্ডিত হয়েছেন কয়েকজন র্যাব সদস্য। এখন সর্বোচ্চ আদালতের আওতায় রয়েছে বিষয়টি। তবে সব ক্ষেত্রে অভিযোগ আমলে নেওয়া হয় এমন নয়।
সম্প্রতি মার্কিন সিনেটের কয়েকজন সদস্য সে দেশের পররাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রীকে একটি যৌথ চিঠি দিয়েছেন। তাঁদের অভিযোগ, র্যাব সদস্যদের হাতে ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত চার শতাধিক ব্যক্তি বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। সিনেট সদস্যদের চিঠিতে বলা হয়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার পর এ ধরনের হত্যার প্রবণতা বাড়তে থাকে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞসহ অনেকেই সরকারের নজরে আনলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। সিনেটররা চিঠিতে এ সংস্থার কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে গুম ও নিরাপত্তা হেফাজতে নির্মম নির্যাতনের অভিযোগও করেছেন। দাবি করা হয় সংস্থা–সংশ্লিষ্ট সিনিয়র কমান্ডারদের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের। এ চিঠি প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারের প্রতিক্রিয়া আমরা জানতে পারিনি। কিন্তু সরকারের সুস্পষ্ট অবস্থান থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজন দায়ী সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
২০০৪ সালের মার্চ মাসে র্যাব গঠিত হয়। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অন্য বাহিনীকে সহায়তা, সন্ত্রাসী সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং নির্দেশিত যেকোনো মামলার তদন্ত এ প্রতিষ্ঠানের মৌলিক দায়িত্ব। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (সংশোধনী) আইন, ২০০৩ অনুসারে এর গঠন। পুলিশের মহাপরিদর্শকের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সংস্থার কাঠামোতে পুলিশ ছাড়াও সশস্ত্র বাহিনীগুলোর ব্যাপক প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। একে অত্যাধুনিক অস্ত্রেও সজ্জিত করা হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যে সমৃদ্ধ বাহিনীটি।
তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে মেট্রোপলিটন কিংবা জেলা পুলিশ সাধারণত আগে কিছুই জানে না। এ নিয়ে সমন্বয় সমস্যা কিছুটা হলেও মোটামুটি কাজ চলছে। কোনো স্থানে র্যাবের উপস্থিতির ছাপ থাকে। তবে তা করার জন্য বিনা বিচারে মানুষ মারা, কাউকে গুম করা কিংবা অমানবিক নির্যাতন সমর্থনযোগ্য নয়। এ বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে প্রতিবাদ হচ্ছে দীর্ঘদিন। তবে যাঁদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণভার, তঁারা কি বোঝেন সেটা অজ্ঞাত। তাঁরা একটু কঠোর হলে এমন হওয়ার কথা নয়। তা হচ্ছে না এটা সুস্পষ্ট। পাশাপাশি এটা ছড়িয়ে পড়ছে অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে। সাম্প্রতিক কালে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে কম আসেনি। কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহা হত্যা ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। উল্লেখ করা যায়, গত এক বছরের অধিক কাল টেকনাফ একটি মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছিল। প্রবল চাপের মুখে একজন ওসিসহ কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। তদন্তের দায়িত্বে র্যাব। সে র্যাবে পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আইনের আশ্রয় পাবেন না, এমন নয়। তবে তা যাতে প্রশ্রয়ের নামান্তর না হয়, সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। সে হত্যা মামলার পর বেশ কিছুটা সময় এ ধরনের অভিযোগ আসেনি। বলতে হয় এর আগে এ ধরনের খবর প্রতিদিনকার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল।
তবে সপ্তাহ দুয়েক আগে সিলেট মহানগরীর একটি পুলিশ ফাঁড়িতে এক যুবককে পুলিশের একজন উপপরিদর্শক ও তাঁর সহযোগীরা পিটিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগ আসে। চেষ্টা করা হয় বিষয়টি দ্রুত ধামাচাপা দিতে। করানো হয় ময়নাতদন্ত। তদন্ত প্রতিবেদনে ছিল আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত হলে দেখা যায় শতাধিক আঘাতের সুস্পষ্ট চিহ্ন মৃতদেহে রয়েছে। সংশ্লিষ্ট উপপরিদর্শক পালিয়ে গেছেন তাঁর এক সহকর্মীর সহায়তায়। দুজন উপপরিদর্শককে সাসপেন্ড করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ঘটনার সহযোগী কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবলকে। সংগঠিত অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টার জন্য প্রথম ময়নাতদন্তকারীকে এ মামলায় আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করা যায়। আমরা বুঝতে অক্ষম, কয়েকজন পুলিশ সদস্যের অপচেষ্টার দায় কেন গোটা সিলেট পুলিশ বহন করতে গেল। ঘটনার পরপরই তাদের গ্রেপ্তার করলে পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি আরও বৃদ্ধি পেত। পুলিশ আমাদের নিত্যদিনের সহযোগী। নিরাপত্তা বিপন্ন হলে আমরা তাদের কাছেই যাই। অনেক জায়গায় ভালো কাজ করে তারা প্রশংসিত। কিন্তু এ ধরনের কাজের দায় বাহিনীটির ওপরে এসে পড়েছে। মূলত দায় আসছে দেশের ওপর। আমরা তো পুলিশ ছাড়া চলতে পারব না। কোনো দেশই পারে না। আর যারা আইন ভঙ্গ করে, করে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি; পুলিশ তাদের ধরবেই। তারা পুলিশের ওপর প্রীত হওয়ার কোনো কারণ নেই। নেই প্রয়োজনও। তবে ব্যাপারটা যখন বিপরীতমুখী হয়, তখন আতঙ্কিত হই আমরা।
অন্যান্য দেশেও অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সময় তাদের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে মারা যেতে পারে কিংবা আত্মরক্ষার্থে কখনো কখনো তা ঘটে। সরকারি কর্তৃপক্ষ তা তদন্ত করে দেখে, ঘটনার যথার্থতা নিরূপণের চেষ্টা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রশাসনিক ব্যবস্থাটিকে ওলটপালট করে দিয়েছে। র্যাবের বিষয়ে কয়েকজন মার্কিন সিনেটরের অভিযোগটি হয়তো–বা এখনকার মতো সামাল দেওয়া যাবে। কিন্তু অবস্থার মোড় ফেরাতে না পারলে একসময় ক্ষতিকর পর্যায়ে চলে যেতে পারে। একজন সংসদ সদস্যের পুত্র, যিনি নিজে সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলর, তঁার বিরুদ্ধে র্যাব একটি গুরুতর অভিযোগের ভিত্তিতে ত্বরিতগতিতে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে যে ব্যবস্থা নেয়, তা সারা দেশে প্রশংসিত হয়েছে। এসব বিষয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও জানান দেওয়া আবশ্যক। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে র্যাবের সাফল্য ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। এখন প্রয়োজন আর কোনো বিতর্কিত কাজে যাতে তারা না যায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। তা রাখতে হবে তাদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে। র্যাব গঠনের সময় এর বিরোধিতা ছিল রাজনৈতিক মহল থেকে। ক্ষমতায় এসে এখন তারাই র্যাবকে ব্যবহার করছে। জনজীবনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য এসব সংস্থা আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এদের পেশাগত সামর্থ্য বাড়ানোর জন্য দরকার অব্যাহত প্রচেষ্টা। একসময় সে প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক সমাজ সহায়তা দিয়েছে। এখনো মানবাধিকার সংরক্ষণ বিষয়ে সতর্ক থাকলে সে ধরনের সহায়তা মিলবে। কেটে যাবে এ ধরনের অভিযোগের চাপ। জাতীয় জীবনে আরও মর্যাদার আসনে আসবে বাহিনীটি।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব