মার্চের শুরুতে আবহাওয়ার গরমকে ছাড়িয়ে গেছে বাজারের গরম। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, চিনি, ভোজ্যতেলসহ প্রায় সব ভোগ্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, এক সপ্তাহে আটা ও ময়দার দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে। খামারে চাষ করা মাছের দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ থেকে ৫০ টাকা। বোতলভর্তি ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে দফায় দফায়। খোলা সয়াবিন ও পাম তেল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ছে সব ধরনের মাংস ও ডিমের দাম।
আমদানিকারকেরা যুক্তি দেখাচ্ছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ছে বলে দেশের বাজারেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণ পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রায় সব পণ্যের দামই বেড়েছে। বাংলাদেশে চালের দাম উন্নত দেশের চেয়েও বেশি। এর কারণ বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আগে অন্তত মন্ত্রীরা আওয়াজ দিতেন, এখন আওয়াজটি ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। টিভিতে দেখলাম, নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে গিয়ে বাজার তদারক করছেন। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। আমাদের মন্ত্রীরা নিজেরা যেমন বাজার করেন না, বাজারের খোঁজও রাখেন না।
রোজায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। বাণিজ্যমন্ত্রীর সুবচন কোনো কাজে লাগবে না। গত বছর সরকার যখন অযৌক্তিকভাবে জ্বালানির দাম বাড়িয়ে দিল, বিশেষজ্ঞরা নিষেধ করেছিলেন। নীতিনির্ধারকেরা শোনেননি। ফলে পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ খরচ বেড়েছে। কেবল ভোগ্যপণ্য নয়, দাম বাড়ছে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসসহ প্রায় সব সেবা পণ্যের।
আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দেওয়া হয়। যেসব পণ্য দেশে উৎপন্ন হয়, সেসব পণ্যের দাম কেন লাগামছাড়া? ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার পেছনে কী যুক্তি আছে? গত বছর সরকারি গুদামে চালের মজুত কম ছিল, এই সুযোগে একশ্রেণির আড়তদার ও মিলমালিক চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার শুল্ক কমিয়ে প্রচুর চাল আমদানির ব্যবস্থা করে। ভারতে চালের দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম। ফলে আমদানি করলে ব্যবসায়ীদের লাভ বেশি। আবার আমদানি না করলে আড়তদার ও মিলমালিকদের সুবিধা। দুদিকেই ক্রেতা ও ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত। সরকার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কৃষকদের কাছে থেকে চাল ও ধান সংগ্রহ করলে মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি মুনাফা করতে পারতেন না। কৃষকেরাও লাভবান হতেন। সরকারের বাজার তদারকি ইঁদুর-বিড়াল খেলায় পরিণত হয়েছে। এখানে বিড়াল ইঁদুরকে তাড়া করছে না, ইঁদুরই বিড়ালকে তাড়া করছে।
রোজায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। বাণিজ্যমন্ত্রীর সুবচন কোনো কাজে লাগবে না। গত বছর সরকার যখন অযৌক্তিকভাবে জ্বালানির দাম বাড়িয়ে দিল, বিশেষজ্ঞরা নিষেধ করেছিলেন। নীতিনির্ধারকেরা শোনেননি। ফলে পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ খরচ বেড়েছে। কেবল ভোগ্যপণ্য নয়, দাম বাড়ছে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসসহ প্রায় সব সেবা পণ্যের। এলপিজি বা তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ১৫১ টাকা (১২ কেজি)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেবা পণ্যের ওপর সরকারি ভর্তুকি কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন। আমরাও মনে করি, সেবা পণ্যের ওপর সবাই সরকারি ভর্তুকি পেতে পারেন না। ভর্তুকি তঁাদেরই দেওয়া উচিত, যঁাদের আয় কম। বাংলাদেশ যে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি করছে, তার সুফল পাচ্ছেন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। বৃহত্তর জনগণ দিনযাপনের গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছেন। করোনার অভিঘাতও তাঁদের ওপর বেশি পড়েছে। দারিদ্র্যের হার বেড়েছে।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা পণ্যের দাম কমাতে না পারলেও গরিব মানুষকে উপহাস করে যাচ্ছেন। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে একজন মন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে; তাই বেশি দাম হলেও তঁাদের সমস্যা হবে না। আরেকজন মন্ত্রী বলেছেন, মানুষের হাতে টাকা আছে বলে তাঁরা চিকন চালের ভাত খাচ্ছেন। ফলে চিকন চালের দাম বেড়েছে। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তারপরও মন্ত্রীরা বড় বড় কথা বলেন। গরিব ও প্রান্তিক মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করেন। এই অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? মন্ত্রীদের কথাবার্তা শুনে অনেকেই মন্তব্য করেছেন, জনগণের ভোটে ‘নির্বাচিত’ হলে কেউ এ রকম কথা বলতে পারেন না।
এই মন্ত্রীরা যদি ভিআইপি গাড়ি থেকে নেমে একবার টিসিবির গাড়ির সামনে দাঁড়াতেন, দেখতে পেতেন কম দামে দুই কেজি চাল ও আটা পাওয়ার জন্য মানুষ কী মরিয়া। অনেকে চলন্ত গাড়ি ধরার চেষ্টা করেন জীবনের ঝুঁকি নিয়েও। কেবল গরিব মানুষ নন, সাদা পোশাক পরা নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন একটু সাশ্রয়ের জন্য।
সরকারের জানা উচিত প্রবৃদ্ধি কিংবা মাথাপিছু আয় বাড়লেই মানুষের উন্নয়ন হয় না, প্রকৃত উন্নয়ন তখনই হবে, যখন সব মানুষের মৌলিক চাহিদা তথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া নিশ্চিত হবে। যখন প্রতিটি সামর্থ্যবান নাগরিক যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাবেন। বাংলাদেশে উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৈষম্যও বেড়েছে। অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের অন্যতম সদস্য রেহমান সোবহান বলেন, পাকিস্তান আমলে দুই অর্থনীতি ছিল। এখন দুই সমাজ হয়েছে। মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বিপুল অর্থ। আর বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নিঃস্ব থেকে নিঃস্ব হচ্ছে। সরকারের উন্নয়ন নীতি পরিকল্পনায় এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নেই। তাদের উন্নয়ন হলো তেলা মাথায় তেল দেওয়া। লুটপাটকারীদের সুবিধা করে দেওয়া। দ্রুত অতিধনি হওয়া দেশের তালিকায় বাংলাদেশ এক নম্বরে।
সরকার গরিব মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যেসব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়েছে, তার একটা বড় অংশ লাভের গুড় পিঁপড়ায় খেয়ে নিচ্ছে। আগে স্থানীয় সরকার সংস্থার প্রতিনিধিদের মধ্যে একটা রাজনৈতিক ভারসাম্য থাকত। কিছুটা হলেও জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহি করতে হতো। দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার সংস্কার নির্বাচন করায় এখন আর ওসবের বালাই নেই। লাখ লাখ টাকা নিয়ে যিনি মনোনয়ন কিনে নেন, তিনি নির্বাচিত হয়ে সেই টাকাটা তুলে নেবেনই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ৯৫ শতাংশ ক্ষমতাসীন দলের, মনোনীত অথবা বিদ্রোহী।
করোনাকালে যখন সাধারণ মানুষ কাজ হারিয়েছেন, যাঁদের রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে, তাঁদের জন্য দেওয়া সরকারের যৎসামান্য আর্থিক সহায়তাও ঠিকমতো পৌঁছানো যায়নি চুরিচামারি ও স্বজনপ্রীতির কারণে। অনেক জনপ্রতিনিধি বমাল ধরাও পড়েছেন। ঢাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণের একটি বাস্তব ঘটনার বর্ণনা দেন আমাদের একজন সহকর্মী। তাঁর গাড়ির চালক যে এলাকায় থাকেন, সেই এলাকার কাউন্সিলর ও তাঁর লোকজন আগের দিন গিয়ে কাগজে সবার সই নিয়ে গেছেন। বলেছেন, পরদিন চাল দেওয়া হবে। কিন্তু কাউন্সিলরের অফিস থেকে যে চাল দেওয়া হয়েছে, তা খাওয়ার অযোগ্য। এই হলো সরকারি ত্রাণসামগ্রী বিতরণের নমুনা!
দেশ যখন করোনার প্রকোপ থেকে অনেকটা মুক্ত, তখনই বাজারের আগুন জনগণ তথা সীমিত আয়ের মানুষকে মহাদুর্যোগের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। যে সিন্ডিকেট বরাবর বাজার কারসাজি করে মন্ত্রীর সদুপদেশ ও মৌখিক হুঁশিয়ারি, তাদের বশে আনতে পারবে না। এ জন্য বাজার তদারকির কাজটি জোরদার করতে হবে। সেই সঙ্গে যেসব অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, গুজব ছড়িয়ে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্তত দৃষ্টান্তমূলক হলেও দু–চারজনকে শান্তি দিন।
এ মুহূর্তে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষকে একটু স্বস্তি দিতে সরকার আরেকটি কাজ করতে পারে। ভোজ্যতেলসহ আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো। শুল্ক কমালে পণ্যের দামও কমে যাবে। আর ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় থেকে যেসব নেতা-কর্মী চাঁদাবাজি করছেন, উপঢৌকন আদায় করছেন, তাঁদেরও কঠোর হাতে দমন করতে হবে।
আওয়ামী লীগের যে নেতারা কথায় কথায় বিএনপিকে তুলাধোনা করেন, তাদের শাসনামলের বিভিন্ন অনাচার নিয়ে কথা বলেন, তাঁরা যদি একটু নিজের দলের দিকে নজর দিতেন, সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেত। একদা ‘জনবিচ্ছিন্ন’ বিএনপির প্রতি যদি মানুষ ফের ঝুঁকে থাকে, তার শতভাগ কৃতিত্ব আওয়ামী লীগেরই। সরকার উন্নয়নের যতই অলীক খোয়াব দেখাক না কেন, সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তারা চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে, তাদের জন্য কিছু একটা করুন।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি