মাননীয়, মহামান্য কিংবা স্যার-ম্যাডাম সমাচার

সন্দ্বীপে আমার গ্রাম থেকে পরিচিত জনৈক পল্লিচিকিৎসক মুঠোফোনে জানতে চাইলেন, তাঁরা কি নামের আগে আর ডাক্তার লিখতে পারবেন না! কণ্ঠে ছিল উদ্বেগ ও হতাশা, সমাজে মানহানির ভীতি। ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমে জানতে পারি, সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ একটি মামলায় রায় দিয়ে বলেছেন, কেবল এমবিবিএস চিকিৎসকেরা নামের আগে ডাক্তার (ডা.) ব্যবহার করতে পারবেন। সংবাদটি আমাকেও খানিকটা মর্মাহত করেছিল। রায়টির অনুলিপি সংগ্রহের পর পাঠ করে দেখলাম, মামলাটি খারিজ হয়েছে এবং এমবিবিএস ছাড়া আর কেউ নামের আগে ডাক্তার লিখতে পারবেন না মর্মে কোনো আদেশ হয়নি। তবে মাননীয় আদালত সরকারের বিবেচনার জন্য রায়ের শেষাংশে কিছু পরামর্শ রেখেছেন।

মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯৮০-তে এমবিবিএস চিকিৎসকেরা ব্যতীত আর কেউ নামের আগে ডা. সম্ভাষণ বা পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না মর্মে কোনো বিধান ছিল না। ২০১০ সালের নতুনভাবে প্রতিস্থাপিত আইনের ২৯(১) ধারায় একটি বিধান করা হয়েছে। ন্যূনতম এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রি না থাকলে কেউ নামের পূর্বে ডাক্তার পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না। বিধানটি কেবল অ্যালোপ্যাথি ধারার চিকিৎসকদের জন্য প্রযোজ্য হবে বলে মনে হচ্ছে।

চিকিৎসকদের নামের আগে লিখিত বা ব্যবহৃত ডাক্তার (ডা.) শব্দটি মূলত পদবি নয়, সৌজন্যপূর্ণ বা সম্মানসূচক সম্ভাষণ। হোমিও, হেকিমি, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, কবিরাজি ইত্যাদি চিকিৎসাশাস্ত্রের চিকিৎসকেরা ডা. সম্ভাষণ ব্যবহার করলে তা প্রায়োগিক অর্থে অশুদ্ধ হবে না। ফিজিক্যাল মেডিসিন, ফিজিওথেরাপি ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসাশাস্ত্র। তাঁরাও চিকিৎসক এবং চিকিৎসাসেবা প্রদান করে থাকেন। নামের আগে তাঁদের ডা. ব্যবহার করতে বাধা থাকার কথা নয়। ডিগ্রিপ্রাপ্ত পশুচিকিৎসকেরা নামের আগে ডা. লিখতে পারবেন কি না, ভেটেরিনারি প্র্যাকটিশনার্স অরডিন্যান্স, ১৯৮২-তে তার উল্লেখ নেই। সরকারস্বীকৃত স্বল্পমেয়াদি কোর্স সম্পন্ন করে হাজার হাজার পল্লিচিকিৎসক গ্রামীণ জনপদে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা সবাই নামের আগে ডা. লেখেন কি না, জানা নেই। তবে অনেকেই লেখেন। গ্রামদেশে সাধারণ মানুষ তাঁদের ‘ডাক্তার সাব’ বলেই সম্বোধন করে থাকেন।

হেকিমি, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও কবিরাজি চিকিৎসাব্যবস্থা ইউনানি অ্যান্ড আয়ুর্বেদিক প্র্যাকটিশনার্স অরডিন্যান্স, ১৯৮২ দ্বারা স্বীকৃত ও নিয়ন্ত্রিত। অধ্যাদেশের ৩৪(২) ধারায় হেকিমি, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, কবিরাজি চিকিৎসার পেশাজীবীদের নামের আগে ডাক্তার শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ব্যবহারিক দিক থেকে বিধানটি যৌক্তিক। ইউনানি পদ্ধতির চিকিৎসকদের হেকিম এবং আয়ুর্বেদিক পদ্ধতির চিকিৎসকদের কবিরাজ বলা হয়। চিকিৎসাসেবাপ্রার্থীদের সম্ভাব্য বিভ্রান্তি অপনোদনে এটি সহায়ক হয়। হেকিমি, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, কবিরাজি তথা ট্রেডিশনাল মেডিসিন ও চিকিৎসা হাজার হাজার বছর ধরে প্রচলিত। তাই এসব চিকিৎসাব্যবস্থা এবং চিকিৎসকদের হেয়জ্ঞান করার মানসিকতা পরিহার করতে হবে। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাশাস্ত্র এবং চিকিৎসাব্যবস্থাও আইন দ্বারা স্বীকৃত ও নিয়ন্ত্রিত। হোমিও চিকিৎসকদের আইনের বিভিন্ন স্থানে ‘মেডিকেল অফিসার’, ‘ফিজিশিয়ান’ বলা হয়েছে। কিন্তু হোমিও চিকিৎসকেরা নামের আগে কী বিশেষণ বা সম্ভাষণ ব্যবহার করবেন, সেটা বলা হয়নি।

হোমিওপ্যাথি, হেকিমি, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, কবিরাজি ইত্যাদি চিকিৎসাব্যবস্থা শত শত বছর ধরে আইনসিদ্ধভাবেই প্রচলিত রয়েছে। তাঁদেরও মানুষ ডাক্তার, কবিরাজ, হেকিম, ইত্যাদি নামে সম্বোধন করে থাকে। চিকিৎসাপ্রার্থী কোনো মানুষকে এটা নিয়ে বাধ্য করা যাবে না যে তিনি কোন পদ্ধতিতে চিকিৎসা গ্রহণ করবেন।

ইংরেজি ডা. শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে চিকিৎসক। যেকোনো শাখার চিকিৎসক নামের পূর্বে ডা. লিখে আইনি বাধ্যবাধকতাসহ নামের শেষে তাঁর চিকিৎসাশাস্ত্রের ধরন এবং তদ্বিষয়ে অর্জিত একাডেমিক যোগ্যতা যেমন, অ্যালোপ্যাথি-সংশ্লিষ্ট এমবিবিএস, এফআরসিএস, এমএস, মেডিসিন, সার্জারি ইত্যাদি উল্লেখ করে থাকলে জনগণ বিভ্রান্ত না হয়ে নিজ নিজ পছন্দমতো চিকিৎসক নির্বাচন করতে পারবেন। এমনকি হোমিও, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ধারার চিকিৎসকেরাও নামের পূর্বে ডা. লিখে বন্ধনীতে শাখা উল্লেখপূর্বক আইনি বাধ্যবাধকতাসহ নামের শেষে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসাশাস্ত্রের নাম এবং অনুরূপ শাস্ত্রে অর্জিত ডিপ্লোমা বা ডিগ্রি উল্লেখ করে থাকলে অভিন্ন ‘ডা.’ সম্ভাষণসহ নিজ নিজ ধারার চিকিৎসাপেশা চর্চা করতে পারেন। নামের আগে ‘ডা.’ পদবি অপেক্ষা নামের শেষে বর্ণিত যোগ্যতা অধিক গুরুত্ব বহন করে।

নামের পূর্বে সম্ভাষণ ব্যবহার মূলত রীতি, আইনি আবশ্যকতা নয়। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারকগণের নামের পূর্বে সম্মানসূচক ‘বিচারপতি’ সম্ভাষণ ব্যবহার করা হয়। এটি দীর্ঘদিনের ব্যবহৃত প্রতিষ্ঠিত রীতি। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত আইনের সংজ্ঞামতে, প্রতিষ্ঠিত রীতিও আইন। নিম্ন আদালতের বিচারকদের বিজ্ঞ বা ‘ইয়োর অনার’ এবং উচ্চ আদালতের বিচারকদের ‘মাই লর্ড’ সম্বোধন করার একটা রেওয়াজ প্রচলিত আছে।

অর্থ, বিত্ত, সম্পদ ও পেশাগত পদমর্যাদার ভিত্তিতে শ্রেণিভেদ বা বিভাজন স্পষ্টিকরণ কি খুবই প্রয়োজনীয়? কর্ম দিয়েই মানুষের পরিচয় প্রতিফলিত হতে পারে। কথায় বলে, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়।’

রাষ্ট্রপতি পদবির পূর্বে ‘মহামান্য’ এবং প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীগণের পদবির পূর্বে ‘মাননীয়’ সম্ভাষণ ব্যবহারের সাংবিধানিক বা সংবিধিবদ্ধ কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বিষয়টি দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত রীতি। ‘মহামান্য’ সম্ভাষণের ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই। অনেকে পদস্থ আমলাদের পদবির শেষে মহোদয় সম্বোধন করেন। অতি বিনয়ী অনেকে আবার আগে মাননীয় ও পরে মহোদয় সম্বোধন করেন। রাষ্ট্রদূতগণ নামের পূর্বে মান্যবর ( এক্সিলেন্সি) সম্ভাষণ ব্যবহার করেন। আইনগত ভিত্তি না থাকলেও এটিও দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত বৈশ্বিক রীতি। সম্ভাষণের বিষয়টির আবার আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে মি. প্রেসিডেন্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে মি. প্রাইম মিনিস্টার সম্বোধন করলে তাঁরা রুষ্ট হবেন না। কারণ, উন্নত সেসব দেশে সেটাই শোভন রীতি।

অধুনা নতুন কিছু কিছু রীতি সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষণীয়। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নিজ নিজ শ্রেণিভেদ ও অহং সত্তার উন্নততর প্রজাতির প্রতিফলনের স্বার্থে নামের আগে অ্যাম্বাসেডর, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, বিজ্ঞানী ইত্যাদি ব্যবহার করছেন। অবসরপ্রাপ্ত লেখেন না। ফলে বুঝতে বেগ পেতে হয়, তিনি কি অবসরপ্রাপ্ত না কর্মরত। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা নামের পূর্বে সামরিক পদবি ব্যবহার করে বন্ধনীর মধ্যে ‘অব.’ ব্যবহার করেন। এটি শুদ্ধ পদ্ধতি। এটিও প্রতিষ্ঠিত রীতি। তবে, এখানেও সমাজের বিশেষ সুবিধাভোগীদের শ্রেণিসচেতনতার প্রতিফলন লক্ষণীয়। সংবিধানে বিঘোষিত আইনের দৃষ্টিতে সমতা, কর্মের সম্মান ও সাম্যবাদের রাষ্ট্রীয় নীতির পরিপন্থী এমন মনস্তত্ত্ব পরিত্যাজ্য।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন অদ্ব্যর্থক ভাষায় সেদিন বললেন, আমলাদের ‘স্যার’, ‘ম্যাডাম’ সম্বোধনের কোনো রীতি নেই। সহমত পোষণ করে আমি বলব, রীতি আছে, আইন নেই। এমন সব সম্ভাষণ আত্মম্ভরিতা সৃষ্টি করে। অনেক সময় অসংযত দম্ভ থেকে আমলারা অশিষ্ট আচরণ করেন। ২০১৯ সালের ১৭ মে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের এসি (ল্যান্ড) সঞ্চিতা কর্মকার ‘স্যার’ সম্বোধন না করায় এক নিরক্ষর দরিদ্র মাছবিক্রেতার মাছের ডুলা, মাছসহ লাথি মেরে পাশের ড্রেনে ফেলে দিয়েছিলেন। চলতি বছরের জুলাই মাসের কোনো একদিন মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের ইউএনওকে ‘স্যার’ সম্বোধন না করে ‘আপা’ সম্বোধন করায় জনৈক ব্যবসায়ীকে মারধর করা হয়েছিল। মিডিয়ায় পরিবেশিত সংবাদ থেকে বিষয়টি জেনেছিলাম। অর্থ, বিত্ত, সম্পদ ও পেশাগত পদমর্যাদার ভিত্তিতে শ্রেণিভেদ বা বিভাজন স্পষ্টিকরণ কি খুবই প্রয়োজনীয়? কর্ম দিয়েই মানুষের পরিচয় প্রতিফলিত হতে পারে। কথায় বলে, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়।’

কাজী হাবিবুল আউয়াল সাবেক সিনিয়র সচিব