নারী নির্যাতনের অপবাদ মাথায় নিয়ে স্বাধীন ভারতে কোনো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে কখনো পদত্যাগ করতে হয়েছে কি না, মনে করতে পারছি না। দুর্নীতির দায়ে অবশ্যই একাধিক নাম মনে পড়ছে। টি টি কৃষ্ণমাচারি, সম্মুখম চেট্টি, কে ডি মালব্য, জর্জ ফার্নান্দেজ, কল্পনাথ রাই, নটবর সিং, এ রাজা। আদর্শগত বিরোধে মন্ত্রিসভা ছেড়েছিলেন অনেকেই। যেমন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বি আর আম্বেদকর। রাজনৈতিক অঙ্ক কষে তো ভূরি ভূরি। জগজীবন রাম, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, রামবিলাস পাসোয়ান, সি ডি দেশমুখ। আবার রেল দুর্ঘটনার নৈতিক দায় মাথায় নিয়ে মন্ত্রিত্ব ছেড়েছিলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও মাধব রাও সিন্ধিয়ারা। কিন্তু নারী নির্যাতন? নাহ। মোবাশার জাবেদ আকবর (এম জে আকবর) ছাড়া আর কোনো মুখ ভেসে উঠছে না। সম্ভবত তিনিই প্রথম।
কিন্তু শেষ কি না, সে কথা বলার সময় এখনো আসেনি। ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ আন্দোলনের জেরে ঠগ বাছতে শেষমেশ গাঁ উজাড় হবে কি না, সেই ভাবনা গেড়ে বসছে। বর্ষার কালো মেঘের চরাচর ছাওয়ার মতো সেই সঙ্গে বেড়ে চলেছে সংশয়মিশ্রিত আগ্রহ। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কত না ময়াল–অজগর বেরিয়ে পড়ে! পাশ্চাত্যের হ্যাশট্যাগ মি টু ঢেউ আচমকা আছড়ে পড়ার পর আপাতত গোটা ভারতের মন–মনন এই নিয়ে আচ্ছন্ন।
এমন যে হতে পারে, এ দেশে কারও মনে সেই ধারণা ছিটেফোঁটাও উঁকি মেরেছিল কি? যৌন–লাঞ্ছিত আফ্রো–আমেরিকান মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী তারানা বার্কি ২০০৭ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যখন এই ‘মি টু’ শব্দবন্ধের জন্ম দিয়েছিলেন, সহানুভূতির সঙ্গে নির্যাতিত নারীদের ক্ষমতায়নে সচেষ্ট হয়েছিলেন, তখন তিনিও সম্ভবত ধারণা করেননি ১০ বছরের মধ্যে তাঁর দেশে এই শব্দবন্ধ এক অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনের জন্ম দেবে। এবং সাত সাগর তেরো নদী পেরিয়ে সেই আন্দোলন নাড়িয়ে দেবে সনাতন ভারতের সমাজ ও রাজনীতিকে। কিংবা তারও এক যুগ আগে, নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় পপ গায়িকা আলিশা চিনাই যখন হিন্দি ফিল্ম দুনিয়ার প্রসিদ্ধ মিউজিক ডিরেক্টর অানু মালিকের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ এনেছিলেন, তখনো কেউ ভাবেনি, শুধু বিনোদনের জগৎ নয়, ভারতে বিভিন্ন পেশার সফল মানুষজনের বিরুদ্ধে একদিন এভাবে গর্জে উঠবে নারীসমাজ।
পাঞ্জাবি রমণী আই এ এস রূপান দেওল বাজাজের নামটাই বা ভুলি কী করে? বিচ্ছিন্নতাবাদী খলিস্তানি আন্দোলনের টুঁটি টিপে মারতে যাঁর ‘অবদান’ ভোলার নয়, সেই ডাকসাইটে আইপিএস অফিসার পাঞ্জাব পুলিশের ডিজি কানওয়ার পাল সিং গিলকে (কেপিএস গিল নামে সমধিক পরিচিত) যৌন হেনস্তার অপরাধে আইনি লড়াইয়ে দোষী প্রতিপন্ন করেছিলেন রূপান। ১৯৯৬ সালে একটি পার্টিতে মদ্যপ অবস্থায় অনেক মান্যগণ্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে রূপানের সঙ্গে গিল অসভ্যতা করেছিলেন। সেই লড়াইটা রূপানকে কিন্তু একাই লড়তে হয়েছিল। সমাজ আজকের দিনের মতো সেদিন তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়নি। ক্ষোভ ও হতাশা বরাবরই ছিল। কিন্তু তা ক্রোধের রূপ ধরে আছড়ে পড়ল বলিউডের বঙ্গতনয়া তনুশ্রী দত্ত মারফত। সাহসে ভর দিয়ে যখন তিনি শুনিয়ে দিলেন দশ বছর আগে কীভাবে তাঁকে যৌন লাঞ্ছনা করেছিলেন অভিনেতা নানা পাটেকর, নৃত্য পরিচালক গণেশ আচার্য ও অন্যরা।
ভারতীয় সমাজের নানা স্তরে নানা রূপে যৌন নির্যাতনের দেরাজের ঢাকনা সেই যে হঁা হাঁ উন্মুক্ত হয়ে গেল, তা থেকে ক্রমেই উঠে আসছে একের পর এক লাঞ্ছনার কাহিনি। বিনোদন দুনিয়ার চৌকাঠ টপকে সেই কাহিনি ঢুঁ মেরেছে করপোরেট, ক্রীড়া, শিল্প–সাহিত্য, সাংবাদিকতা মায় রাজনীতির জগতে। ভারতীয় সমাজ যে এভাবে বদলে যাচ্ছে, এত দিন কারও নজরে আসেনি।
সেদিক থেকে সাবেক অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত পাকাপাকিভাবে একটা দাগ কেটে গেলেন। যেমন ভিন্ন কারণে আপাতত ‘অনন্য’ হয়ে রইলেন আকবর। এই মাপের এক সাংবাদিক–সম্পাদকের এই পরিচিতি অবশ্যই কাম্য নয়। আদালত তাঁকে নির্দোষ প্রমাণ করা পর্যন্ত এই কলঙ্ক তাঁকে বয়ে যেতে হবে।
এমন নয় যে এ দেশে এম জে আকবরই একমাত্র সাংবাদিক হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলনের জেরে যাঁর ‘চাকরি’ গেল। হিন্দুস্তান টাইমস–এর রাজনৈতিক সম্পাদক প্রশান্ত ঝা, টাইমস অব ইন্ডিয়ার হায়দরাবাদের রেসিডেন্ট এডিটর কে আর শ্রীনিবাস, ডিএনএ সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গৌতম অধিকারী কিংবা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার প্রিন্সিপাল করেসপনডেন্ট মায়াঙ্ক জৈনও এই তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এম জে আকবরের সঙ্গে এঁদের পার্থক্য দুটি ক্ষেত্রে। প্রথমত, এম জে আকবর মন্ত্রী, এঁরা নন। দ্বিতীয়ত, অভিযোগ আসামাত্র সত্যাসত্য বিচারের আগেই প্রত্যেকের প্রতিষ্ঠান তাঁদের পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছে। কেউ কেউ ইস্তফা দিয়েছেন স্বতঃপ্রণোদিতভাবেও।
কিন্তু এম জে আকবর সেই রাস্তায় হাঁটেননি। অভিযোগ ওঠার আট দিন পর দেশে ফিরে বিবৃতি দিয়ে প্রথমে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। এ দেশের রাজনীতিকেরা সচরাচর যা করে পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, এম জে আকবরও সেই পথের পথিক হয়ে ব্যক্তিগত বিষয়টিতে রাজনীতির রং লাগালেন। সেই সঙ্গে মামলার হুমকি শুনিয়ে রাখেন। পরের দিন তিনি মামলা করেন প্রথম অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে। বিস্ময় জাগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আচরণে। কোন যুক্তিতে এবং কেন তিনি এত দিন ধরে এম জে আকবরকে প্রশ্রয় দিলেন, তার কোনো সহজবোধ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি। আরও দশটা বিষয়ের মতো এ ক্ষেত্রেও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কোনো মন্তব্য দেশবাসী শুনতে পেল না। অথচ তিনিই ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ স্লোগানের জন্মদাতা!
বিস্ময় আরও একটি ক্ষেত্রে। ভারতীয় রাজনীতিতে যে নারীদের নাম তালিকার শীর্ষে, তাঁরা এই বিষয়ে এখনো অদ্ভুতভাবে নীরব। মমতা, মায়াবতী, সুষমা কিংবা সোনিয়াদের নীরবতা ব্যাখ্যার অতীত। কিন্তু তাতে কী আসে যায়? সাড়ে তিন দশক কেটে গেলেও ভারতীয় সংসদ নারী বিল পাস করেনি। নারীর ক্ষমতায়ন তাতে থমকে গেলেও থেমে থাকেনি। হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন বুঝিয়ে দিল, সমাজের অভ্যন্তরে মানসিকতার বিপুল এক পরিবর্তন সবার অলক্ষ্যে ঘটে গেছে।
সাহসের এই বীজ কিন্তু বপন হয়েছিল ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে, যেদিন ‘জ্যোতি’ নামের এক নারী রাজধানী দিল্লির চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার হন। নৃশংস অত্যাচারের পর যাঁকে চলন্ত বাস থেকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। কয়েক দিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হার মানতে হয় তাঁকে। এবং জ্যোতি থেকে যাঁর রূপান্তর ঘটে ‘নির্ভয়া’য়।
সেই ঘটনা জন্ম দিয়েছিল নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার সাহস। জন্ম হয়েছিল দেশজুড়ে এক আন্দোলনের। আইন বদলাতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। নির্ভয়া হয়ে উঠেছিলেন প্রতিবাদের প্রতীক।
নির্ভয়া যে অর্থে এক মাইলফলক, হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলনও তেমন। ভারতে সেই আন্দোলনের পাখা মেলে দিলেন তনুশ্রী। তিনি সাহসী না হলে কে জানে, এম জে আকবরের অতীত এভাবে উন্মোচিত হতো কি না। এভাবে মাথা নিচু করে তাঁকে চলে যেতে হতো কি না।
এম জে আকবরের ইস্তফা ভারতীয় রাজনীতি অথবা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় বিশাল কোনো শূন্যতা সৃষ্টি করবে না। রাজনীতিক হিসেবে তিনি নিতান্তই হালকা। এ দেশের খুব ছোট মাপের জননেতারও যত অনুগামী থাকে, তা–ও তাঁর নেই। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে প্রধানত মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ রক্ষার কাজ তিনি দক্ষতার সঙ্গে করে যাচ্ছিলেন। একটা ভরসার জায়গা তিনি তৈরি করতে পেরেছিলেন। বিজেপির মতো ‘হিন্দুত্ববাদী’ দল ও সরকারে তিনি ছিলেন আধুনিক ও উন্নতমনা এক ‘মুসলমান মুখ’।
এম জে আকবরের সরে যাওয়া বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ছোট হলেও অবশ্যই একটা ধাক্কা। বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্রমেই তিনি নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পেরেছিলেন। বাংলা ভাষা জানা, বোঝা ও বলতে পারা তার একটা বড় কারণ। কংগ্রেস আমলে প্রণব মুখার্জির যে অধিষ্ঠান বাংলাদেশের রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষের কাছে ছিল, বিজেপির আমলে সেই জায়গা সেভাবে কেউ আদায় করতে পারেননি। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসার পর থেকে এম জে আকবর ক্রমেই হয়ে উঠেছিলেন সেই সেতু। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে জানা, বাঙালির আবেগ ও মানসিকতাকে বোঝার ক্ষমতা ছিল বলেই বাংলাদেশের রাজনীতিকদের কাছাকাছি অনেক দ্রুত তিনি পৌঁছাতে পেরেছিলেন। নরেন্দ্র মোদিকে এই শূন্যস্থান ভরাট করার যোগ্য মানুষের খোঁজ এখন করতে হবে।
হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন এখনো পর্যন্ত সমাজের উচ্চবর্গীয় ও সামাজিক মাধ্যমগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু সমাজের অন্য স্তরে এই ঢেউয়ের পৌঁছে যাওয়াটা স্রেফ সময়ের ব্যাপার। একটা মাস আগেও কি কেউ ভেবেছিল, এই ঝাপটায় উড়ে যাবে তাবড় সব নাম, পড়বে এম জে আকবরের মতো উইকেট? করপোরেট দুনিয়া, ক্রীড়া, সংবাদপত্র, শিল্প–সাহিত্য, বিনোদন অথবা রাজনীতি, সবখানেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে অভিযোগের তালিকা। এ এক নিঃশব্দ বিপ্লব।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি