বিদ্বৎমহলে অভিযোগ আছে, বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসবিমুখ। এই বিমুখতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। শিক্ষার সনদের সঙ্গে যেহেতু জীবিকার সম্পর্ক আছে, তাই তাদের ইতিহাসবিমুখতা বোধগম্য। কিন্তু একই অভিযোগ আছে সাধারণ ‘শিক্ষিত’ সমাজের বিরুদ্ধেও। সম্ভবত এর একটা কারণ আমাদের ইতিহাসের বইপত্র নীরস ও একঘেয়ে বিবরণে ভরা। বাঙালি রসিক জাতি, রসকষহীন কোনো কিছুই তাকে টানে না। অত্যন্ত সিরিয়াস বিষয়ও তার সামনে সরসভাবে উপস্থাপিত না হলে সে বইপত্র থেকে মুখ সরিয়ে রাখে।
তবে ইদানীং কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে; নিরেট ইতিহাস নিয়ে লেখা বইপত্রও উপন্যাসের মতো পাঠকপ্রিয় হচ্ছে। খোদ পুস্তক প্রকাশকেরাই এমন কথা বলছেন।
এর একটা কারণ সম্ভবত এই যে ইতিহাস নিয়ে ননফিকশন বইপত্রের লেখার ধরন বদলে যাচ্ছে। নীরস ও একঘেয়ে বিবরণের পরিবর্তে প্রাঞ্জলভাবে গল্প বলার কৌশল যুক্ত হচ্ছে। এই ধরনের লেখায় এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান মহিউদ্দিন আহমদের বইগুলো। তিনি এমনভাবে লিখছেন, পশ্চিমে যেটাকে বলে ‘ন্যারেটিভ ননফিকশন’। এই ধরনের লেখার মূল বৈশিষ্ট্য হলো গল্পের ভঙ্গি। তিনি আমাদের রাজনীতির ইতিহাস লিখছেন গল্প বলার ভঙ্গিতে। তা ছাড়া তিনি একসময় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন; স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাবলির অংশ ছিলেন এবং পরবর্তীকালে পেছনফেরা পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণে মোটের ওপর বস্তুনিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করেছেন; তা ছাড়া তিনি একজন গবেষণাপ্রবণ লেখক। এসব কারণে তাঁর লেখা বইগুলো প্রচুর পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ‘বেস্টসেলার’ ননফিকশন লেখকদের তালিকায় তিনিই সম্ভবত এখন শীর্ষে রয়েছেন।
তাঁর লেখা যে তিনটি বই এ বছর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমহলে সাড়া জাগিয়েছে, সেগুলো হলো প্রতিনায়ক: সিরাজুল আলম খান, লাল সন্ত্রাস: সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি এবং অপারেশন ভারতীয় হাইকমিশন। এই ছোট্ট নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় মূলত তাঁর তৃতীয় বইটি। এখানে জায়গার অভাবে বইটি নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাওয়া সম্ভব হবে না। মোটাদাগে বইটির মূল বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার চেষ্টা করাই উদ্দেশ্য।
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৫ সাল সর্বাধিক ঘটনাবহুল বছর। বছরটির শুরুতে, জানুয়ারি মাসে বাকশাল নামক একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন, মধ্য আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও তার ফলে ক্ষমতার পালাবদল, সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান; রক্তপাত, নৈরাজ্য, রাষ্ট্রক্ষমতা সংহতকরণের চেষ্টার বিপরীতে আরও অভ্যুত্থানের চেষ্টা—এত সব ঘটনার ঘনঘটার মধ্যে ২৬ নভেম্বর ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনে কয়েকজন তরুণের দুর্বোধ্য ‘অপারেশন’ নিয়ে লেখা মহিউদ্দিন আহমদের ১৩৫ পৃষ্ঠার বইটি যেন এক থ্রিলার উপন্যাস। (গত মার্চে প্রকাশিত প্রথমা প্রকাশনের বইটির প্রথম মুদ্রণ ইতিমধ্যেই ফুরিয়ে গেছে।)
জাসদ-গণবাহিনীর ছয় তরুণ সেদিন ঢাকার ধানমন্ডিতে ভারতীয় হাইকমিশনের ভবনে গিয়েছিলেন তৎকালীন হাইকমিশনার সমর সেনকে ‘জিম্মি করে’ তাঁদের কিছু ‘দাবি আদায়ের’ উদ্দেশ্যে। তার আগে কয়েক দিন ধরে তাঁরা সমর সেনের চলাফেরা ও তাঁর অফিস রেকি করেছিলেন। কিন্তু তারও আগে তাঁরা রেকি করেছিলেন বাংলাদেশে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টারের অফিস ও তাঁর চলাফেরা।
যাহোক, ভারতীয় হাইকমিশনে গণবাহিনীর উদ্দেশ্য সফল হয়নি; ছয় তরুণের চারজনই সেখানে গোলাগুলিতে মারা যান, দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে প্রেরিত হন এবং চিকিৎসারত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। হাইকমিশনার সমর সেনও গুলিবিদ্ধ হন, তাঁকে স্বদেশে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভারতীয় বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ উড়ে আসে; কিন্তু তিনি স্বদেশে ফিরতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। তাঁর ওপর হামলার ওই ঘটনার বিষয়ে তিনি বা তাঁর হাইকমিশন কোনো মামলা করেনি। মামলা করেছিল বাংলাদেশ সরকারের পুলিশ কর্তৃপক্ষ; কিন্তু সেই মামলার শুনানিতে ভারতীয় হাইকমিশনের কেউ সাক্ষ্য দিতে যাননি।
এই ঘটনাকে কেন্দ্রে রেখেই মহিউদ্দিন আহমদ বইটি লিখেছেন কিছুটা প্রামাণ্য পদ্ধতিতে। হাজির করেছেন ওই অপারেশনে অংশগ্রহণকারী এক তরুণের প্রত্যক্ষ বয়ান। তার আগে পাঠককে অবহিত করেছেন সমর সেন সম্পর্কে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতীয় এই কূটনীতিকের গুরুত্বপূর্ণ অবদান তুলে ধরেছেন চমৎকারভাবে। তারপর জাসদের রাজনীতি ও গণবাহিনীর নানা ধরনের রোমান্টিক অ্যাডভেঞ্চারের পরিকল্পনা ও প্রয়াস সম্পর্কে অনেক তথ্য ও গল্প হাজির করেছেন সেসবের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন এমন কয়েকজন মানুষের প্রত্যক্ষ জবানে। তাঁদের কারও কারও বয়ান শুরু হয়েছে অনেক পেছনের ঘটনাবলি থেকে; তাঁরা ২৬ নভেম্বরের ওই অপারেশনের ঘটনায় সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে জাসদ-গণবাহিনীর কর্মকাণ্ড, তাঁদের নেতা-কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও ক্রিয়াকর্মসহ আনুষঙ্গিক প্রচুর ঘটনা ও বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। ফলে তাঁদের সবার গল্প মিলেমিশে একটা সময়ের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ও পরিবেশের চিত্র ফুটে উঠেছে।
লেখক নিজেও তাঁর মনের নানা প্রশ্ন হাজির করেছেন। তিনি যাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাঁদের কাছ থেকেও সেগুলোর উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিছু প্রশ্নের উত্তর মিলেছে, কিন্তু কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। সবচেয়ে বড় কথা, বইটির মূল উপজীব্য বিষয় সম্পর্কে কয়েকটি মূল প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যায়নি। লেখক নিজেই বইটির শেষে কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছেন।
যথা: গণবাহিনী তো প্রথমে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে রেকি করেছিল; কিন্তু তাঁকে বাদ দিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনে কেন অভিযান চালানো হয়েছিল? লেখকের প্রশ্ন, ‘হঠাৎ করে টার্গেট বদল হলো কেন?’ দ্বিতীয়ত, গণবাহিনীর তরুণেরা যখন ভারতীয় হাইকমিশনে অপারেশন চালান, তখন সেখানে ভারতের প্রশিক্ষিত কমান্ডো বাহিনীর দশ-বারোজন সদস্য ছিল; তারা কেন আগেই গণবাহিনীর তরুণদের নিষ্ক্রিয় বা নিরস্ত্র করার চেষ্টা না করে গুলি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করেছিল?
আরও প্রশ্ন হলো, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কেন এই ঘটনায় মামলা করেনি? কেন বাংলাদেশ পুলিশের করা মামলায় সাক্ষ্য দিতেও যায়নি?
একটা মৌলিক প্রশ্ন হলো, ভারতীয় হাইকমিশনে অপারেশন পরিচালনার সিদ্ধান্তটি এসেছিল কোথা থেকে? অপারেশনের নির্দেশদাতা গণবাহিনীর ঢাকা সিটির কমান্ডার আনোয়ার হোসেন একাই কি সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন? নাকি তা জাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং গণবাহিনীর রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের মিলিত সিদ্ধান্তই ছিল? জাসদ ও গণবাহিনীর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মিলিত সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলে প্রশ্ন জাগবে: এমন অপটু, বালখিল্য ও অতিমাত্রায় বিপজ্জনক পদক্ষেপ তাঁরা কী বিবেচনায় নিয়েছিলেন, যার রাজনৈতিক পরিণতি জাসদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়েছে?
প্রশ্ন জাগবে: পতঙ্গ আকর্ষণকারী অগ্নিকুণ্ডের মতো দেশপ্রেমিক ও স্বপ্নবান যুবসমাজের একটা বড় অংশকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করেছিল যে রাজনৈতিক দল, সেই জাসদের মূল প্রবণতাই কি ছিল অদূরর্শিতা আর হঠকারিতা?
[অপারেশন ভারতীয় হাইকমিশন, মহিউদ্দিন আহমদ, প্রথমা প্রকাশন, মার্চ ২০২১]
● মশিউল আলম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক