কংগ্রেস সহসভাপতি রাহুল গান্ধী যখন বললেন, পুরো ভারতই পরিবরাতন্ত্রের ভিত্তিতে চলে, তখন তিনি ঠিক বলেননি। শাসন করা মানে কেন্দ্রের ক্ষমতা হাতে রাখা। শুধু জওহরলাল নেহরুর পরিবারই এটা করতে পেরেছে। নেহরু ১৭ বছর শাসন করেছেন, তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী শাসন করেছেন ১৮ বছর এবং তাঁর পুত্র রাজীব করেছেন পাঁচ বছর। অর্থাৎ, এই পরিবার ৪০ বছর ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল, স্বাধীন ভারতের অর্ধেকেরও বেশি সময়। নেহরু এটা নিশ্চিত করেছিলেন যে তাঁর কন্যা যেন শাসক হতে পারেন, একদম তাঁর শাসনের পরে না হলেও অন্তত সময় হলে। আমি যখন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর তথ্য কর্মকর্তা ছিলাম, তখন তাঁকে প্রায়ই বলতাম, আপনি প্রস্তুত থাকুন। বিশেষ করে নেহরুর স্ট্রোকের পর তাঁকে এ কথা বলেছিলাম। শাস্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, নেহরুর মনে তাঁর মেয়েকে নেতা বানানোর ইচ্ছা আছে। ফলে ব্যাপারটা তাঁর জন্য সহজ হবে না। তিনি পণ্ডিতজিকে চ্যালেঞ্জ না করে এলাহাবাদে চলে যাবেন। কিন্তু মোরারজি দেশাই ইন্দিরা গান্ধীকে মানবেন না। নেহরুর মৃত্যুর পর এটা ঘটেছিল। তৎকালীন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট কে কামারাজ নেহরুর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। তিনি এক চাবিতে অনেকগুলো তালা খুলতে চেয়েছিলেন। দক্ষিণের সঞ্জীব রেড্ডি, কলকাতার অতুল্য ঘোষ, বোম্বের এস কে পাতিল—এঁরা সবাই নিজ গুণে নেতা হওয়ার অধিকার রাখতেন। কিন্তু তাঁরা সবাই শাস্ত্রীকে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন। কারণ, শাস্ত্রী নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে যাননি, যেখানে এঁদের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হতে পারে যে তিনি তাঁদের সমপর্যায়ের। তবে শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর ক্ষমতা আবারও পরিবারের হাতে ফিরে আসে।
মোদির সমালোচনা করে রাহুল গান্ধী যখন বলেন, তিনি ‘অসহিষ্ণু পরিবেশ’ তৈরি করেছেন, তখন তিনি ঠিকই বলেন। আজ ভারতের ১৭ কোটি মুসলমান নিজেদের কোথাও দেখতে পায় না। তারা যেন জনসমক্ষে নেই। মনে হচ্ছে, তারা যেন নিজ দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের তকমা পেয়েছে। অন্যদিকে হিন্দুরা সামগ্রিকভাবে দেশ বিভাগের জন্য মুসলমানদের ক্ষমা করতে পারে না। এমনকি আজও যখন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়, তখন মুসলমানদের অবিশ্বাসের চোখে দেখা হয়। এমনকি অন্যভাবে দেখলে বলতে হয়, তাদের বস্তিতে গিয়ে থাকতে হচ্ছে। চাকরিবাকরিতেও তাদের প্রতিনিধিত্ব নগণ্য। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তাদের অংশগ্রহণ কম। ১৯৭৮ সালের সাচার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মুসলমানদের অবস্থা দলিতদের চেয়েও খারাপ।
ভারতের হিন্দুদের কাজ হচ্ছে, এই মুসলমানদের দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের করে আনতে হবে। কিন্তু তাদের অসহায় করে রাখা হচ্ছে। ধর্মের ভিত্তিতে যে দেশভাগ হয়েছে, তার কারণে ভারতের মাসুলমানরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু এখনো তারা ধর্মীয় সংস্কার ধরে রাখার পক্ষে। এমনকি আগে যে অভিন্ন বসতি ছিল, তা–ও হারিয়ে যাচ্ছে, মুসলমানেরা এখন নিজেদের মধ্যে থাকতেই নিরাপদ বোধ করে, যদিও ওই পরিবেশে বসবাস করা অসম্ভব।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শাসনে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার ব্যবধান বাড়ছে। আরএসএস এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে যে মুসলমানরা যেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে না থাকতে পারে। মনে আছে, একজন মুসলমান প্রকৌশলী শ্রীনগর বিমানবন্দরে আমাকে ছেড়ে আসার সময় বলেছিলেন, তিনি চাকরির খোঁজে বেঙ্গালুরুতে গেলে লোকে যখন তাঁর পরিচয় জানতে পারে, তখন তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে বাদ দেওয়া হয়।
কংগ্রেস আজকের বাস্তবতায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে—ব্যাপারটা করুণার উদ্রেক করে। তা না হলে দলটি ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম দিতে পারত। রাহুল গান্ধী হয়তো ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন, তাঁর দলকে আবারও তৃণমূলে কাজ করে মানুষের মনোভাব বদলে দিতে হবে। ভারত তো গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্য লড়াই করেছে। মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহরু উভয়েই মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভারত হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের ঐতিহ্যে লালিত। নেহরুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে—ব্যাপারটা বিস্ময়কর। বিজেপির উদার নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি কিন্তু নেহরুর উৎসাহী অনুসারী ছিলেন।
বাজপেয়ি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন আমি সাংসদ হিসেবে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলেছিলন, নেহরু একসময় যে আসনে বসতেন, তিনি এখন সেই আসনে বসছেন। কিন্তু আজকের বিজেপি নেহরু মেমোরিয়াল সেন্টার থেকে নেহরুর নাম বাদ দিতে চাইছে। তাদের মনে রাখা উচিত, নেহরু সেই নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের একজন, যিনি ব্রিটিশদের তাড়াতে সব ত্যাগ করেছিলেন। তিনি বহুবার কারাবরণ করেছেন। কিন্তু তাতে দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর সংকল্পে চিড় ধরেনি। নেহরুর প্রপৌত্র রাহুল গান্ধীর উচিত তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে লড়াইটা করা। তবে সেটা পরিবারতন্ত্র চিরস্থায়ী করার জন্য নয়, সেটা করতে হবে ভারতের মূল্যবোধ রক্ষার জন্য, অর্থাৎ গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ভারতের মানুষের কাছে কংগ্রেস আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে ঐতিহ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, সেটা হলো, সংঘবদ্ধতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।