অক্সিজেন উৎপাদন কারিগরি দিক থেকে খুব জটিল কোনো প্রযুক্তি নয়। বেশি খরচও লাগে না। মাত্র দুই-তিন কোটি টাকা খরচেই চীন কিংবা জার্মানির অক্সিজেন প্রস্তুতকারকদের সহায়তায় মধ্যমানের একটা অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করা যায়। অথচ সেই পথে না হেঁটে আমরা করোনায় কুপোকাত ভারতের দিকে চেয়ে আছি। যাবতীয় দুর্যোগের সময়ে ভারত কিংবা চীনের ওপর নির্ভর না করে স্থানীয় বিকল্প নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে। দেশীয় উৎপাদন বা আমদানির বিকল্প উৎস থাকা ভালো।
চাল-ডাল-পেঁয়াজের মতো পচনশীল পণ্য ভারত থেকে একচেটিয়া আমদানির অর্থনীতি যৌক্তিক। ভারত থেকে পণ্য ক্রয় পরিবহন খরচ ও সময়ের দিক থেকে সাশ্রয়ী। পচনশীল আমদানি পণ্য দীর্ঘদিন সংরক্ষণের বদলে এখানে ছোট কিংবা মধ্য পরিসরে স্টোরেজের নীতি ব্যবসাসহনীয়। কিন্তু তাই বলে অপরাপর যাবতীয় শিল্পের কাঁচামাল ও তৈরি পণ্য নির্বিচারে ভারত থেকে আমদানি করতে থাকলে সময়ে সময়ে সরবরাহ সংকট তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, মন্দা, অবকাঠামোগত কিংবা মানবসৃষ্ট সমস্যা এবং বিশেষভাবে রাজনৈতিক সংকটের সময় বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক।
ভারত বিশ্বের প্রায় অর্ধেক টিকা উৎপাদন করলেও কাঁচামালের জন্য তারা ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা চীনের ওপর নির্ভরশীল। ধারণা করা হচ্ছে, অতি চাহিদার চাপে, কাঁচামাল সংকটে টিকা উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থাই চাপে পড়েছে। এ অবস্থায় জরুরি সময়ে ভারতের নিজেরই যেখানে টিকা ও অক্সিজেনের জন্য হাহাকার, সেখানে বাংলাদেশের শুধু ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকা বিব্রতকর। না পেয়ে দোষারোপের সংস্কৃতিতে যাওয়াকে ভালো চোখে দেখা যায় না। স্থানীয় চাহিদা মেটাতে জরুরি অবস্থায় ভারতের রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত সময়ের বিবেচনায় যৌক্তিক।
হ্যাঁ, অতীতে চাল-পেঁয়াজসহ বিভিন্ন দরকারি পণ্য রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ভারত বাজে উদাহরণ তৈরি করেছিল। পাট, পাটজাত পণ্য, বাংলাদেশে তৈরি হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ও মাছ ধরার জালের ওপর অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে ভারত বাংলাদেশের কিছু খাতের বেশ ক্ষতি করেছে। তথাপি ভারতের করোনাজনিত অক্সিজেন বিপর্যয়ের মুখে, টিকা তৈরির কাঁচামালস্বল্পতার মধ্যে এই দুটি পণ্যের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা স্বাভাবিক বিষয় বলেই বাংলাদেশকে মেনে নিতে হবে।
স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পরই একটি দেশ বিদেশে পণ্য রপ্তানি করবে। উপরন্তু সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যদি পণ্যমূল্য বাড়িয়ে বেশি লাভ করা যায়, তাহলে সে পথে কে না যাবে? বাণিজ্যে তো বন্ধুত্ব বলে কিছু নেই। লভ্যাংশনির্ভর বাজার অর্থনীতির পাশাপাশি এখানে থাকে আচরণগত অর্থনীতির কৌশল খেলার বিষয়। ফলে চুক্তির টিকাও আসবে, যখন দেখা যাবে টিকার আন্তর্জাতিক চাহিদা কমে যাবে এবং দামও পড়ে যাবে। বিকল্প উৎসহীন একচেটিয়া ও একপক্ষীয় আমদানি নীতিতে গেলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।
এখানে মৌলিক প্রশ্নটি হচ্ছে, কেন শিল্প কাঁচামাল, জীবন বাঁচানোর জরুরি ওষুধ থেকে শুরু করে যাবতীয় ‘তৈরি পণ্য’ একটামাত্র উৎস থেকেই আমদানি করতে হবে? কেন সুই থেকে শুরু করে উড়োজাহাজ পর্যন্ত সবকিছুই আমদানি করতে হবে? একটা কারণ, দেশের শিল্প অবকাঠামো নিয়ে আমাদের কোনো লক্ষ্য ও অভীষ্ট নেই।
দূরদর্শিতা নেই বলে আমাদের কী কী মৌলিক উৎপাদন খাত থাকা চাই, তা সংজ্ঞায়িত হয়নি। তবে কারিগরিভাবে এই উত্তরটি বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে (ডুইং বিজনেস ইনডেক্স) পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ব্যবসা সূচক ১৬৮, বিপরীতে ভারতের ৬৩। বিশ্বে ১৯০টি দেশের মধ্যে প্রতিবেশী দুটো দেশের অবস্থানের পার্থক্য ১০৫। এই সূচকটা একটা আয়না, যেখানে খুব সহজে একটা দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি, শিল্প ও ব্যবসার পরিবেশ বোঝা যায়।
ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে ভারত ও বাংলাদেশের অবস্থানের তারতম্য আকাশ-পাতাল। নির্মাণসংক্রান্ত অনুমতি, পরিবেশ ছাড়পত্র প্রভৃতি ঝামেলায় ভারত বাংলাদেশের চেয়ে ১০৮টি অবস্থান এগিয়ে, বিদ্যুতের সংযোগ ও সাশ্রয়ী জ্বালানির সূচকে তাঁরা বাংলাদেশ থেকে ১৫৪ অবস্থান এগিয়ে। ঋণ প্রাপ্তির দিক থেকে ৯৪ অবস্থান এগিয়ে, বিনিয়োগ সুরক্ষায় ৫৯ অবস্থান।
চুক্তি বাস্তবায়ন, বৈদেশিক বাণিজ্য সুবিধা প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে ৩৬ অবস্থান এগিয়ে। সম্প্রতি একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন, দেশে প্রকৃত করদাতাদের হেনস্তা করা হয় এবং প্রভাবশালীদের ছাড় দেওয়া হয়। এতে সৎ ব্যবসায়ীদের ওপর করের চাপ বাড়ছে। ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে এর সত্যতা মেলে, কর সহজীকরণের দিক থেকে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে ৩৬ অবস্থান এগিয়ে।
এর অর্থ হচ্ছে, ভারতে ব্যবসা ও শিল্প টিকিয়ে রাখা সহজ, পণ্য উৎপাদনের খরচ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক অনেক কম। এভাবে চীনের সঙ্গে তুলনা করা হলে ব্যবধানটা আরও বেমানান ঠেকবে। সুতরাং বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ বড্ড বেশি বলে সবাই চীন ও ভারতমুখী।
সার্বিকভাবে বাংলাদেশে ব্যবসা করা কঠিন এবং পণ্য উৎপাদন করা খরচান্ত ব্যাপার। বগুড়ার মহাস্থান হাট থেকে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে যেতে মহাসড়কের পথে পথে পণ্যবাহী একটি ১০ টনের ট্রাককে চাঁদা দিতে হয় প্রায় সাড়ে ২২ হাজার টাকা (আনোয়ার পারভেজ, ২৬ জুলাই ২০১৩ প্রথম আলো), এমন দেশে পণ্য উৎপাদন হবে না, বরং আমদানিনির্ভরতার কারণে সময়ে সময়ে পণ্যসংকট হবে।
আমাদের প্রবৃদ্ধি যে কর্ম তৈরি করতে পারছে না, বেসরকারি বিনিয়োগ যে এগোচ্ছে না, এটা জানার জন্য অন্য কোনো প্রমাণ ও ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, ব্যবসা সূচকই যথেষ্ট। ব্যবসা সহজীকরণের বিদ্যুৎ উপসূচকে বাংলাদেশের মান ১০০ তে প্রায় ৩৫, ভূমি নিবন্ধনে মাত্র ২৯, ব্যবসায়িক চুক্তি বাস্তবায়নে ২২, অর্থ ও ব্যবসায়িক মামলা নিষ্পত্তিতে মান মাত্র ২৮, বৈদেশিক বাণিজ্যে ৩২। সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, নিরবচ্ছিন্ন সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিশ্চয়তা, পরিবেশ ছাড়পত্র, চুক্তি বাস্তবায়ন, লেনদেনসহ আর্থিক অপরাধের বিচারিক নিষ্পত্তি, ঘুষ দুর্নীতি ও বেপরোয়া চাঁদাবাজি, জ্বালানি সংযোগের দীর্ঘসূত্রতা, পরিবেশ ছাড়পত্রসহ নানাবিধ প্রশাসনিক হয়রানি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে দ্রুত কাটিয়ে ওঠা যায়। ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনার নামে হাজার কোটি খরচ হলো, তার সুফল বিনিয়োগে আসবে কবে? বিদ্যুৎ খাতে সরকার গত ১০ বছরে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিলেও ব্যবসা ও শিল্পের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রাপ্তি সহজ হয়নি। বরং ১০ বছরে ১০ বার বিদ্যুৎ ও জ্বলানির মূল্য বৃদ্ধি ব্যবসা সহজীকরণে বড় বাধা।
ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে অগ্রগতি হলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং কর্মসংস্থান সার্বিকভাবে গতি পাবে। ২০২৪ সালে এলডিসি উত্তরণের আগেই প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ আনার সক্ষমতা, বিনিয়োগের বোধগম্য অবকাঠামোগত উপযোগিতা তৈরি গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য ব্যবসা সহজীকরণ সূচকের প্রতিটি উপখাতেই ব্যাপক অগ্রগতি প্রয়োজন। এই অগ্রগতিগুলো হলেই পরে জরুরি অবস্থায় কিংবা সংকটে বিদেশপানে তাকানোর বাধ্যবাধকতা কমে আসবে। আমদানিকৃত দেশ জরুরি প্রয়োজনে রপ্তানি বন্ধ করলে তাকে দোষারোপের সংস্কৃতি কিংবা বক্রতা থেকেও বাঁচা যাবে।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর-এর লেখক