ভাওয়াইয়া যুবরাজ কছিম উদ্দিন ও জাতীয় সংস্কৃতি

কছিম উদ্দিন
কছিম উদ্দিন

যাকে কয়, মাটির ছাওয়া। সাম্য, মুক্তি, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা, সম্মান, দেশাত্মবোধ ইত্যাদি কথার কচকচানি না শিখেই যাঁরা এসবের জন্য জান বাজি রাখে, ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী কছিম উদ্দিন তেমনই একজন। উইকিপিডিয়া তাঁর সম্পর্কে লিখেছে, কছিম উদ্দিন (মৃত্যু: ২২ আগস্ট ১৯৯২) ছিলেন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত ভাওয়াইয়া গানের একজন অন্যতম প্রধান শিল্পী। শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের পর তাঁকেই ভাওয়াইয়া গানের সবচেয়ে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং ‘ভাওয়াইয়া গানের যুবরাজ’ বলে সম্বোধন করা হয়। শিল্পী কছিম উদ্দিন মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন ক্যাম্পে ভাওয়াইয়া গান গেয়ে সাধারণ জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে ভাওয়াইয়া গানের পাশাপাশি পালাগানও পরিবেশন করতেন।

এঁরা উপনিবেশের মানুষ ছিলেন না। উপনিবেশের মানুষ মানে তো সেই ব্যবস্থার দোসর হওয়া। ছিলেন কোচ-রাজবংশী, চাড়াল-চণ্ডালদেরই সন্তান। কথিত শিক্ষিত হয়ে প্রাণ-প্রকৃতি ও সমাজবিচ্ছিন্ন হওয়ার দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। ফলে তাঁর বিস্মিত হওয়া, ঠোঁট নড়ানো, হাঁটা, সাইকেল চালানো সব তাঁর জনগোষ্ঠীর মতোই। নিজে হালুয়া ছিলেন, জালুয়া ছিলেন, ছিলেন গাড়িয়াল। তাঁকে শিখতে হয়নি, পাখির শাবককে কি উড়তে শেখা লাগে?

আমরা দেখেছি, জনগণের ভাষার টেকনিক আত্মস্থ করে জনগণের অতীতের বীরত্বগাথা রচয়িতাকে জনগণের আসল লড়াইয়ের কালে গণবিরোধী হয়ে ভূমিকা পালন করতে। তাঁরা বাস্তব জীবনে হাজির যুদ্ধের সময় জনগণ যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন হানাদারদের বিমানে চড়ে বিদেশে গিয়ে হানাদারদের পক্ষে কথা বলতে। ফলে এসব সুবিধাবাদীর টেকনিক ধার করতে হয়, কিন্তু কছিম উদ্দিনদের হাওলাত করার ব্যাপার নেই। যাঁর যা আছে, তা-ই যথেষ্ট। তাঁরা জাতির নগদ প্রয়োজন ঠিকই বোঝেন। তিনি ঠিকই গেয়ে ফেলেন, ‘ওকি বাপরে, মুক্তিফৌজ কি যুদ্ধ করে বাপরে!’ এখানে কোনো ধারের ব্যাপার নেই, না বিষয়, না টেকনিক। ফ্রাঞ্জ ফানোর ভাষায়, ‘যেসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণ নিজেদের গড়ে তুলছে এবং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখছে, চিন্তা-চেতনার রাজ্যে তাকে ব্যাখ্যা করা, যৌক্তিক করে তোলা এবং প্রশংসা করার জন্য জনগণের নেওয়া সমস্ত উদ্যোগের নাম হচ্ছে জাতীয় সংস্কৃতি। অনুন্নত দেশগুলোতে জাতীয় সংস্কৃতি রূপ লাভ করবে তাদের মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলনগুলোর অভ্যন্তরে।’ ভাওয়াইয়াশিল্পী কছিম উদ্দিনরা এই জাতীয় সংস্কৃতির নির্মাতাদের একজন। সেই জাতীয় সংস্কৃতি গড়ে উঠলে হয়তো চলতি লেখাটির দরকার হতো না। তাঁর মৃত্যুদিবস ২২ আগস্ট ১৯৯২ জানা গেলেও জন্মতারিখ ধারণা করা হয় ১২ মার্চ ১৯৩৪। তাঁর জন্মতারিখ ভুল হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ।

২.
ভাওয়াইয়ার গুরু একজন বা একাধিক নয়, গণসমষ্টি। গায়কিটা আলো-বাতাসের, ধবধবা বালুচরের, কাঁশিয়ার (কাঁশ ফুল) খেতের ঢেউয়ের, হেকাদোমা বন্ধুর পথের। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ভাষায়, ‘বাহিরানা’ বা আঞ্চলিকতার। লোকসংগীত সংহত সমাজের সামগ্রিক সৃষ্টি। কিন্তু তার নৈর্ব্যক্তিকতা ও মৌখিকতার রূপ ছেড়ে ব্রিটিশ শাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বিভক্তির সঙ্গে এল ভণিতার যুগ। রাধারমণ বলেন, ‘পাগল জালালে কয়’ ধরনের ভণিতা। সম্ভবত, দেশীয় রাজের অধীন থাকায় ভাওয়াইয়া আজও পর্যন্ত সমষ্টির চেতনা নিয়ে হাজির আছে।
যিনি চিলমারী ও ব্রহ্মপুত্রের ওপারে গোয়ালপাড়ার বাঘ বসতি জঙ্গলে জান হাতে নিয়ে হাতির পাল খুঁজে বেড়ান, লোহার অঙ্কুশের ঘা আর গানের নিবেদনে বশ বানান, সেই মাহুতের বীরত্ব-বিরহ ও দারিদ্র্যকে না জানলে গোয়ালপাড়ার মাহুতের গানের মাহাত্ম্য তিনি বুঝবেন কী করে। অথচ কছিম উদ্দিনরা আজ একাডেমিক বস্তু, যেন জাদুঘরের পোড়ামাটি।

৩.
অধিকাংশ লোকসংগীতই পঞ্চস্বরিক বা ঔড়ব জাতীয়। কিন্তু স্বরের আরোহণ, অবরোহণ, সম্বাদী ও বিসম্বাদীর টানাপোড়েনে প্রতিটি জাতির লোকসংগীতের মধ্যে ‘সুর-নকশা’ তৈরি হয় আর তা জাতির বৈশিষ্ট্য, গোটা জীবনের সঙ্গে তা জড়িয়ে থাকে। যত ধরনের গানই বাঁধা হোক না কেন, সেই সুর-নকশা থেকে বেরোতে পারে না। বিশেষ ভৌগোলিক সীমা ও ভাষা নিবদ্ধ একটি জাতির সেটাই মূল সুর। যদিও প্যাটেন্টের যুগ আসায় অনেক ভাওয়াইয়া গীতিকারই না বুঝে নিজেকে সুরকার হিসেবে পরিচয় দেন। যেমন আসাম উপত্যকায় যত রকম গানই থাকুক, তার প্রাণভোমরা বিহু, ধানি রাগের স্বরবিন্যাসের সঙ্গে এর সাদৃশ্য। নেপালিদের যত গান তা হুবহু দুর্গা রাগের পর্যায়ে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ভাষায়, পূর্ববঙ্গের সুর-নকশা হলো ভাটিয়ালি যেমন, মধ্যবঙ্গের যেমন বাউল, তেমনি উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া।

তেমনি বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সুরের ভাবানুষঙ্গ হিসেবে যেসব লৌকিকতার, শুষির, আনন্ধ ও ঘনযন্ত্রের বিকাশ হয়েছে, যেমন একতারা লাউয়া, দোতারা, খমক, আড়বাঁশি, ঢোল, ঢোলক, খঞ্জনি ও মন্দিরা। সেসব শহুরে লোকসংগীতের আসরে ও টেলিভিশনে প্রায় বর্জিত। বিশেষত ভাওয়াইয়ায় কতগুলি শ্রুতির ও মিড়ের কাজ আছে, যা হারমোনিয়াম ও তবলা একেবারে নষ্ট করে দেয়। ঢোলকের লৌকিক তাল তবলায় পাওয়া যায় না। ভাওয়াইয়া-যন্ত্র ছাড়া ভাওয়াইয়া গেয়ে অনেক বিখ্যাত শিল্পীই ভাওয়াইয়ার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটিয়েছেন। কেউ উচ্চারণ রীতির বদল ঘটিয়েছেন গ্রামোফোন কোম্পানির চাহিদায়। খোদ আব্বাসউদ্দীনও এই চাহিদা পূরণ করেছেন এই পথে। কিন্তু কছিম উদ্দিন, যাকে নিজ গাঁ ছেড়ে যেতে হয়নি, তিনিই ভাওয়াইয়ার পথে থেকেছেন, থেকেছেন কুড়িগ্রামে। তিনিই কেবল ‘পাঁচ আনা রুজি করেছেন পাঁচ সিকার খাইয়া’। এই হলেন কছিম উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা কছিম উদ্দিন।

লেখক: সভাপতি, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।
[email protected]