সম্প্রতি মালেক সাহেব (ছদ্মনাম) সপরিবারে ঢাকা শহরের নামকরা একটি রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্নভোজনে গিয়েছিলেন। করোনা মহামারির কারণে অনেক দিন পর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের পীড়াপীড়িতে অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি সেখানে যেতে রাজি হন। মহামারির আগে নানা দিন নানা উপলক্ষে বাইরে খানাপিনার অভ্যাস থাকলেও বর্তমানে সতর্কতার সঙ্গেই তিনি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
সে যা–ই হোক, রেস্টুরেন্টে গিয়ে তালিকা থেকে যার যার পছন্দের খাবার ফরমাশ করা হয়ে গেছে। মালেক সাহেব স্বল্পাহারী এবং বয়স ও রোগবালাই বিবেচনায় চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় পরিহার করেন। তাঁর স্ত্রীও স্বাস্থ্যসচেতনতার কারণে পারতপক্ষে কোমল পানীয়র ধারেকাছে ভেড়েন না। তবে ছেলেমেয়েরা ফাস্ট ফুড আইটেমের পাশাপাশি কোমল পানীয়র ভক্ত। ঠিক হলো, ছেলেমেয়েদের জন্য কোমল পানীয় এবং মালেক সাহেব আর তাঁর স্ত্রী স্বাভাবিক পানি ‘ড্রিংক মেনু’ হিসেবে ফরমাশ করবেন। কিন্তু বিপত্তি বাধল তখনই, যখন রেস্টুরেন্টের তরফ থেকে জানানো হলো, এই রেস্টুরেন্টে ‘ড্রিংক মেনু’-তে ‘নরমাল পানি’র ব্যবস্থা নেই; এমনকি বোতলজাত পানিও তারা সরবরাহ করেন না। খাবারের যেহেতু ফরমাশ হয়ে গেছে, তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা কোমল পানীয়র ফরমাশ দিলেন বা দিতে বাধ্য হলেন। কী সব বিশেষ কারণে এসব রেস্টুরেন্টে খাবারের মেনুর যে অস্বাভাবিক দাম, তা অবশ্য মালেক সাহেবের অজানা। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, যেখানে খোলাবাজারে দুই থেকে সোয়া দুই লিটারের একই পানীয় বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১১০ টাকা, সেখানে ওই রকম রেস্টুরেন্টে ২০০ মিলিলিটার থেকে ২৫০ মিলিলিটার কোমল পানীয়র দাম রাখা হয় ৮০ টাকা থেকে ১০০ টাকা, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়েও ঢের বেশি।
মালেক সাহেব ভাবতে থাকেন এ রকম আরও অনেক খাদ্য ও সেবা পণ্যের কথা, যেগুলোর উৎপাদন খরচই–বা কত যে তাঁর মতো ভোক্তাদের এত বেশি টাকা দিয়ে কিনতে হয় অথবা তাঁরা কিনতে বাধ্য হন। এই যেমন শহর বা পাড়া-মহল্লার দোকানে থরে–বিথরে সাজানো বাহারি পণ্য। রংচঙে মাখা, আকর্ষণীয় মোড়কে বাজারজাত করা আলুর চিপস, লজেন্স, চকলেট, বিস্কুট, আইসক্রিম, ভুনভুনি, কোমল পানীয় ইত্যাদি নানা নামের বিভিন্ন সামগ্রী, এসবের প্রকৃত উৎপাদন খরচ কত? বলে রাখা ভালো, এসব পণ্যের ক্রেতারা অধিকাংশই দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত।
এই যেমন একজন রিকশাচালক, রাস্তার শিশু, টোকাই, বাসচালক-সহকারী, নির্মাণশ্রমিক, ক্লান্ত পথিক ইত্যাদি। উচ্চ মূল্য তো আছেই, গুণগত মান সম্পর্কেও নানা কথা বাজারে প্রচলিত। মালেক সাহেব এসব নিয়ে প্রায়ই ভাবেন। তিনি তো আর বিজ্ঞানী নন অথবা খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিষয়ে অনেক পড়াশোনার সময় পান—সে রকম কেউই নন।
একদিন বিকেলবেলায় হাঁটাহাঁটির সময় নাছোড়বান্দা দুই পথশিশু তাঁর পিছু নেয়। তারা ‘টাকা দেন টাকা দেন, কিছু খাব টাকা দেন’—এসব বলতে থাকে। মালেক সাহেব টাকা দিলে ওরা কী করে না করে এসব ভেবে মুদি দোকানের সামনে এসে বলে, ‘তোরা কী নিবি বল?’ তারা বাহারি রঙের ‘চকোবল’-এর দুটি প্যাকেট নিল। দুই প্যাকেটের মূল্য বাবদ দোকানদারকে ২০ টাকা বুঝিয়ে দিয়ে যেই তিনি হাঁটতে যাবেন, দেখা গেল আরেক বিপত্তি। নাছোড়বান্দা টোকাই ছেলে দুটি আরও টাকা চায়। কেন? ওরা প্যাকেট ছিঁড়ে দেখে একজনের প্যাকেটে ৮টি ভুনভুনি আর অন্যজনের প্যাকেটে ১৪টি! এ নিয়ে দুই শিশুর মধ্যে ঝগড়া। একই দামের দুটি প্যাকেট, একই কোম্পানির তো বটেই, কিন্তু কোনো প্যাকেটে ৮টি তো অন্য প্যাকেটে ১৪টি! এসব বিষয় তাঁকে যথেষ্ট পীড়া দেয়। উচ্চবিত্ত তো বটেই, এমনকি মধ্যবিত্তরাও অনেকেই এসব পণ্য এড়িয়ে চলেন, কিন্তু কোথাও না কোথাও মালেক সাহেবদের মতো ঠিকই জরিমানা গুনতে হয়।
শুধু কি এসব প্রক্রিয়াজাত পণ্যেই মূল্য ও গুণগত মানের এ রকম অস্বাভাবিকতা? মোটেই তা নয়। মালেক সাহেবের ছোট ভাই এবং নিকট আত্মীয়ের অনেকেই কৃষিনির্ভর জীবন যাপন করেন। অনেকেই এখন কৃষিকাজ করতে চান না। তাঁদের অভিযোগ, তাঁরা উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য তো দূরে থাক, অনেক সময় উৎপাদনমূল্যও পান না। মালেক সাহেবের কাছে প্রায়ই এসব কথা বলার জন্য তাঁর গ্রামের লোকজন ফোন করেন, আদেশ–নির্দেশ–উপদেশ চান। এই যেমন টেলিভিশনে গ্রামের কোনো চাষি খবর শুনেছেন, গ্রামের বাজারে তিনি যে বেগুন ১০ টাকা কেজি বিক্রি করেছেন, তা নাকি শহরে ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি। আরও কত খবর? যেমন: গ্রামের গোয়ালার ৪০ টাকার গাভির দুধ শহরে ৮০ টাকা, ৩০ টাকার আম ৭০ টাকা, ১৫ টাকার কাঁচা মরিচ ৬০ টাকা ইত্যাদি।
কোরবানি উপলক্ষে পালন করা গ্রামের ব্যাপারীর গরুটির দাম যেখানে মানুষ লাখ টাকাই দাম করে না, সেখানে শহুরে খামারিরা দেদার ১০ থেকে ২০ লাখ টাকায় গরু বিক্রি করছে। নানা কারণে মালেক সাহেবের কাছে তাঁর গ্রামের লোকজন পরামর্শ চায়। তারা জানতে চায়, একই জিনিসের দামে গ্রাম আর শহরে এত ফারাক কেন? কারা নেয় সেই বর্ধিত দামের লাভের অংশ? এসব ভাবতে ভাবতে মালেক সাহেবের নজরে আসে ৭ আগস্ট ‘দৈনিক বণিক বার্তা’ পত্রিকাটি। সেখানে শিরোনাম ছিল এ রকম, কৃষিপণ্যে মুনাফার ৮০ শতাংশই ভোগ করে ফড়িয়া পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী।
প্রতিবেদনে মোট লাভের বিভাজনে দেখা যায়, বেগুনের ক্ষেত্রে ১০০ টাকা মুনাফা হলে তার সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৪৩ শতাংশ ভোগ করে খুচরা বিক্রেতা, ২৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ পাইকার এবং ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ ফড়িয়া। সারা বছরেই তরকারিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় আলুর ক্ষেত্রে খুচরা বিক্রেতা ৩৩ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং পাইকার ৪৪ দশমিক ২৯ শতাংশ মুনাফাভোগী। এসব পাইকার, খুচরা বিক্রেতা ও দালালের পাশাপাশি আরও একশ্রেণির মানুষ তথাকথিত মজুতদারি ব্যবসা করে প্রচুর মুনাফা লুটে থাকে। এই যেমন দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের এক মজুতদার ৮০০ টাকা মণ দরে ভুট্টা কিনে মজুত করে এবং তিন মাসের ব্যবধানে সেগুলো ১ হাজার ১০০ টাকা মণে বিক্রি করে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা লাভ করেছেন বলে তাঁর কেরামতি জাহির করছিলেন।
মালেক সাহেব সেবা খাতের বিভিন্ন কারবারি সংগঠনের কথা ভাবেন আর দেখেন, সেখানেও একই অবস্থা। একবার তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে গেলেন বিগত বছরের আর্থিক বিবরণী ওঠানোর জন্য। সদাশয় ব্যাংক কর্মকর্তা তাঁকে একটি ফরম পূরণ করতে বললেন। ফরমটি আর কিছুই নয়, আর্থিক বিবরণী উত্তোলনের বিপরীতে তিনি ৫০০ টাকা সার্ভিস চার্জ আর ৭৫ টাকা ভ্যাট দিতে রাজি আছেন, এ মর্মে সম্মতিপত্র। উপায়হীন মালেক সাহেব ভাবতে থাকেন, এক থেকে দুই পৃষ্ঠার একটি আর্থিক বিবরণী দিতে ব্যাংকের না জানি কত খরচ হয়! তিনি আরও ভাবেন, রোগবালাই হলে ডাক্তারের কাছে অবশ্যই যেতে হয়। সেখানে ডাক্তারের ফি, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রোগ নির্ণয় ফি, একটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের দাম, হাসপাতালের শয্যা-কেবিন ইত্যাদির ভাড়া কেমন করে যেন নির্ধারিত হয়, তা তিনি কোনোভাবেই মেলাতে পারেন না। এই যেমন করোনা টেস্টের মূল্য কোথাও ৩০০ টাকা আবার কোথাও একই কর্মের ফি কী করে ৩ হাজার টাকা হয়? তিনি আরও ভাবেন, তথাকথিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার কীভাবে মুনাফা অর্জিত হতে পারে? বেসরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ডিগ্রির জন্য টিউশন ফিসহ অন্যান্য খরচের আকাশ-পাতাল তারতম্য কে জানে কী কারণে হয়?
মালেক সাহেব ভাবেন, মুনাফা অর্জনে কথিত আমদানিকারকেরাও কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। কর্তব্যকাজে তিনি কয়েকটি দেশ ঘুরেছেন। এই যেমন চীনের কোনো একটা পণ্য জাপানে যে দাম, বাংলাদেশে তার চেয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি দাম। কিন্তু পণ্যের গুণগত মানের ব্যাপক তারতম্য। চীন বা অপরাপর দেশ রপ্তানির স্বার্থে জাপান ও আমেরিকার জন্য যে মানের পণ্য তৈরি করে, বাংলাদেশ বা অপরাপর বাজারের জন্য সে গুণগত মান নিশ্চিত করে না বলেই জনশ্রুতি আছে। তাহলে বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে আমদানি করা পণ্যের আকাশচুম্বী দাম হাঁকিয়ে অর্জিত লাভ কারা ভোগ করে? মালেক সাহেবদের মতো এমন ভাবনা এ দেশের অনেকেই ভাবেন। কিন্তু কোনো সমাধান পান না।
অর্থনীতিতে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ঠিক কী পরিমাণ লাভ বা মুনাফা করবে, সে সম্পর্কে তত্ত্ব আছে বটে; এই যেমন ‘অপ্টিমাল প্রফিট থিওরি’ বা সর্বোচ্চ মুনাফা তত্ত্ব এবং ‘স্যাটিসফাইসিং প্রফিট থিওরি’ বা সন্তোষজনক মুনাফা তত্ত্ব। একটা সময়জুড়ে ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ মুনাফার দিকেই ধাবিত হতো। যেমন কেউ ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে লাভ করল ৫০ টাকা, কেউ ১০০ টাকা আবার কেউবা ১ হাজার টাকা বা তার চেয়েও অনেক বেশি। এই যে কথিত শতকরা ৫০ ভাগ, ১০০ ভাগ, ১ হাজার ভাগ মুনাফা, সেখানে নীতি–নৈতিকতা কোথায়? এখানে নানামুখী অশুভ প্রতিযোগিতা, অন্যায্য কার্যকলাপের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা এত বেশি মুনাফা করে থাকে।
কিন্তু আশার কথা হলো আধুনিক অর্থনীতি বর্তমানে ব্যক্তি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে সন্তোষজনক মুনাফা অর্জনের কথা বলে। সন্তোষজনক মুনাফা তত্ত্বের মূল কথা হলো বিনিয়োগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুনাফা করা। কারও বিনিয়োগ ১০০ টাকা হলে ১৫ শতাংশ মুনাফা হিসাবে তার লাভ হবে ১৫ টাকা, আবার কারও বিনিয়োগ ১ কোটি টাকা হলে একই হারে তার মুনাফা হবে ১৫ লাখ টাকা। সন্তোষজনক মুনাফা তত্ত্বে ন্যায্যতা ও সমতার কথা বলা হয়। লাভের উপলক্ষ থাকলেই নীতি–নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে দেশ ও দেশের মানুষকে জিম্মি করে মুনাফা করতে হবে, এমন কোনো তত্ত্ব আধুনিক অর্থনীতি ও নীতিশাস্ত্র প্রত্যাখ্যান করে।
ব্যবসায়ীরা ভেবে দেখবেন কি, তাঁদের ব্যবসার ধরনের সঙ্গে সংগতি রেখে কতটুকু মুনাফা করা সন্তোষজনক?
ড. শহীদুল জাহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক।