মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা থাইল্যান্ডের মায়ে সোত এলাকার একটা নোংরা ভবনে ঢুকলাম। একতলা ভবন। এটি পোশাক তৈরির কারখানা। ঘরটায় কয়েকটি জানালা আছে বটে কিন্তু কোনো বৈদ্যুতিক পাখা নেই। ছাদ এত নিচু যে মাথা ছাদের সঙ্গে গুঁতা খাওয়ার অবস্থা হয়। এ চরম অস্বাস্থ্যকর জায়গায় বসে ২৬ জন শ্রমিক দিনের পর দিন টানা ১৫ ঘণ্টা করে কাজ করে গেছেন। এখানেই ডিজনি, স্টারবাক, এনবিসি ইউনিভার্সাল এবং টেসকোর মতো বিশ্বখ্যাত কোম্পানির পোশাক তৈরি হতো।
এ কারখানার কোনো নাম নেই। তবে মালিকের নাম কানলাইয়ানি রুইয়েনগ্রিথ। তাঁর নামে সবাই এটিকে কানলাইয়ানি ফ্যাক্টরি বলে থাকে। অন্য আরেকটি বড় কারখানার কাছ থেকে সাবকন্ট্রাক্টে তারা কাজ করছিল। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কানলাইয়ানি কারখানার করুণ দশা নিয়ে গণমাধ্যমে একটি প্রতিবেদন বের হওয়ার পর স্টারবাক কোম্পানি কানলাইয়ানি কারখানাকে সাবকন্ট্রাক্টে কাজ দেওয়া কোম্পানির অর্ডার বাতিল করে দেয়। ফলে কানলাইয়ানি কারখানা কাজ হারায়। এখানে ডিজনি, এনবিসি ইউনিভার্সাল এবং টেসকোরও কাজ চলছিল। তারাও বিপদে পড়ার ভয়ে এ কারখানাকে কাজ দেওয়া মূল কারখানার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। ফলে কানলাইয়ানির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকেরা চাকরি হারান। শ্রমিকেরা তাঁদের পাওনা বেতন–ভাতা চাইলেও মালিক পক্ষ তা দিচ্ছিল না। একপর্যায়ে শ্রমিকেরা শ্রম আদালতে মামলা করেন। আদালত গত বছরই এক রায়ে কারখানা কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকদের বেতন–ভাতা ও আনুষঙ্গিক ক্ষতিপূরণ বাবদ ১ লাখ ১১ হাজার মার্কিন ডলার দিতে আদেশ দেন। প্রায় এক বছর পার হয়েছে। শ্রমিকেরা সেই ক্ষতিপূরণের অর্থ পাননি।
ডিজনি, স্টারবাক, এনবিসি ইউনিভার্সাল এবং টেসকোর সর্বমোট সম্পদের ৫১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। কিন্তু এই চার কোম্পানি মিলে শ্রমিকদের পাওনা ১ লাখ ১১ হাজার মার্কিন ডলার পরিশোধ করার ‘সামর্থ্য’ অর্জন করতে পারেনি। তারা নির্বিকারভাবে ঘোষণা করেছে ওই কারখানার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
থাইল্যান্ডের মায়ে সোতে এলাকার কারখানাগুলো বহু আগে থেকে পোশাকশ্রমিকদের নিপীড়ন করার বিষয়ে কুখ্যাত। এখানে সাড়ে ৪৪ হাজার পোশাকশ্রমিক কাজ করেন। তাঁদের বেশির ভাগই মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পার হয়ে কাজ করতে আসেন। নিতান্ত পেটের দায়ে পড়ে তাঁরা কাজ করতে আসেন।
এশিয়ার যত জায়গায় পোশাক তৈরির কারখানা রয়েছে, তার সবখানে পোশাকশ্রমিকেরা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। শ্রমিক শোষণ অবসানে এ বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর যেখানে অগ্রণী ভূমিকা রাখার কথা ছিল, সেখানে তাদেরই মুনাফাসর্বস্ব নীতি শ্রমিক শোষণের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে
কানলাইয়ানি কারখানার কাজ হারানো শ্রমিক মা-তিন বলেছেন, ‘এখানকার বেশির ভাগ কারখানাই শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি দেয় না। কিন্তু আমরা যদি এ মজুরিতে কাজ করতে রাজি না হই, তাহলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে।’
মা-তিনের মতো হাজার হাজার শ্রমিক একেবারে নামমাত্র মজুরিতে কাজ করছেন। এ তথ্য বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডের কোম্পানিগুলো ভালো করেই জানে। কিন্তু নিজেদের মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য তারা তাদের পোশাক তৈরি করে দেওয়া কারখানাগুলো সব শর্ত পূরণ করছে কি না, তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। যখন কোনো কারখানায় শ্রমিক নির্যাতন হচ্ছে বা নিম্নতম মজুরি দেওয়া হচ্ছে না বলে খবর বের হয়, তখন এসব বিদেশি ব্র্যান্ডের কোম্পানিগুলো তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এটি তারা করে থাকে শুধু দায় এড়ানোর জন্য।
মা-তিন বলেছেন, ‘আমরা কোনো রকমের ভবিষ্যতের আশা ছাড়াই দিনের পর দিন খেটে খেটে বেঁচে থাকি। আমাদের যদি রোগশোক হয়, তাহলে ডাক্তার যে দেখাব সে সামর্থ্যও আমাদের থাকে না।’
কানলাইয়ানি কারখানার যে ২৬ জন শ্রমিক ক্ষতিপূরণের মামলা করেছিলেন, তাঁদের কোনো কারখানা আর চাকরি দেয়নি। প্রতিটি কারখানায় তাঁদের নাম–পরিচয় পাঠিয়ে বলে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা ঝামেলা পাকাবে। তাঁদের অধিকার নিয়ে যে শ্রমিক ইউনিয়ন কথা বলবে, সে পথও মালিকশ্রেণি বন্ধ করে রেখেছে।
থাইল্যান্ডের এই শ্রমিক নির্যাতনের সংস্কৃতি অনেক পুরোনো। বলা যায় এ অবস্থা কয়েক দশক ধরে জিইয়ে রাখা হয়েছে। আর এসবের পেছনে যারা কলকাঠি নেড়ে থাকে তারা আর কেউ নয়, তারা হলো বিশ্বখ্যাত পোশাক কারখানাগুলো, মুনাফাই যাদের কাছে শেষ কথা। শুধু থাইল্যান্ডে নয়, বিশ্বের যত জায়গায়, বিশেষ করে এশিয়ার যত জায়গায় পোশাক তৈরির কারখানা রয়েছে, তার সবখানে পোশাকশ্রমিকেরা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। শ্রমিক শোষণ অবসানে এ বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর যেখানে অগ্রণী ভূমিকা রাখার কথা ছিল, সেখানে তাদেরই মুনাফাসর্বস্ব নীতি শ্রমিক শোষণের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ইলানা উইন্টারস্টেইন: আন্তর্জাতিক শ্রমিক অধিকারকর্মী