বেশ কিছুদিন হলো, বিতর্ক চলছে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। আকস্মিকভাবে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রসঙ্গ। পরেরটি আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠার কারণ, কিছুদিন আগে প্রকাশিত ‘সেন্টার ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি’র র্যাংকিং বিষয়ে প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনে বিশ্বের এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই নাম নেই। এ থেকে গণমাধ্যমে অনেকেই উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বলেছেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা কোনো ক্রমেই বিশ্বমানের হচ্ছে না। বিষয়-বিশেষজ্ঞ বিশিষ্টজনদের অনেকেই বলেছেন, দেশে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। ক্যাম্পাসগুলোতে নিয়মনীতি কিংবা আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই; মিছিল, মিটিং, বোমাবাজি, হরতাল, খুন নিত্যদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। অহরহ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হচ্ছে। সেশনজট ভয়াবহ আকার পেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস-জীবন প্রলম্বিত করছে। তাঁদের পর্যবেক্ষণে সংখ্যায় কম হলেও এমন অনেক শিক্ষকই আছেন, যাঁদের ক্লাস নেওয়ার সময় নেই, মাসের পর মাস চলে যায়, পরীক্ষার উত্তরপত্র দেখার সময় পান না। নিছক একাডেমিক বিষয় নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সময় দিতে তাঁরা অপারগ। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ নেই—এই অজুহাত দেখিয়ে অনেক শিক্ষক দেশের বাইরে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। অপর দিকে যাঁরা যান না কিংবা যেতে পারেন না, তাঁরা নানা ধরনের স্নায়ুচাপে ভোগেন।
বাস্তবে তো এমন হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েরই একসময় আন্তর্জাতিক মহলে খ্যাতি ছিল। শিক্ষার মান বিচার করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলা হতো। নর্থ আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ পরিচিতি ছিল ‘বুয়েটের’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর সম্মানসূচক ডি লিট ডিগ্রি নেওয়ার সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন ফরাসি মনীষী আন্দ্রে মার্লো। ইউরোপের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে তিনি অনেক ইতিবাচক কথা বলেছিলেন।
খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে প্লেটো এথেন্সে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সত্য। কিন্তু আজকের দিনের বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ধারণা, তার অনুসরণে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় খ্রিষ্টীয় নবম শতকে, বাংলাদেশের নওগাঁর সোমপুর (পাহাড়পুর) বৌদ্ধবিহারে। দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, শারীরতত্ত্ব প্রভৃতি ছিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের বিষয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে দল বেঁধে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এখানে আসত পড়ালেখা করতে। বলা বাহুল্য, এর প্রায় ২০০ বছর পর, একাদশ শতকে আধুনিক ধারার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ইতালিতে, সালোনা ও বলোনা নামে।
যে দেশ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃৎ ছিল, সে দেশে শিক্ষার এখন এমন দুরবস্থা কেন? এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? কেউ কেউ বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেকেলে পদ্ধতি ‘একাডেমিক অবসেলেন্স’ বাদ দিতে হবে। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে জ্ঞান সংগ্রহ, সঞ্চারণ, উদ্ভাবন ও সৃজনের প্রতিষ্ঠান। এখনকার বিশ্ববিদ্যালয় শেখায় জ্ঞান ও প্রচলিত বিশ্বাসের কাছে মাথানত না করতে এবং জ্ঞানের ও উপলব্ধির নতুন নতুন জগৎকে নির্মাণ করতে। আমাদের দেশে তার প্রয়োগ নেই বলেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। বিশিষ্টজনদের আরেকটি গুরুতর অভিযোগ হলো, পশ্চিমা দেশগুলোতে ‘অধ্যাপনা ও গবেষণাকে’ একই সূত্রে পরিমাপ করা হয়, যা আমাদের দেশে আদৌ করা হয় না। তাঁরা বলছেন, এটিও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিযোগিতার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।
দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যা আরও বেশি। অনেক বিতর্ক আছে সেগুলো নিয়ে। তবে বিতর্ক যতই থাক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হবে না কোনো অবস্থাতেই। কারণ, প্রতিবছর যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পাস করে আসে; তার এক-তৃতীয়াংশ মাত্র সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পায়। সে ক্ষেত্রে দেশে উচ্চশিক্ষার ধারাক্রম রক্ষার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন অপরিহার্য। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিষফোড়া হয়ে উঠেছে তার আউট ক্যাম্পাসগুলো। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ওই সব আউট ক্যাম্পাসের অনেক শাখা রয়েছে একেবারে উপজেলা শহর পর্যন্ত। সেখানে পড়ালেখা নামে কিছু আছে বলে মনে হয় না। নিছকই সনদ বিক্রির বাণিজ্য চলে সেখানে। বলা বাহুল্য, কেউ কেউ আউট ক্যাম্পাস বহাল রাখার জন্য আদালতে মামলা ঠুকে বহাল তবিয়তে ছাত্র ভর্তি করছে, সনদ দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কিংবা মঞ্জুরি কমিশনেরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো ক্ষমতা নেই।
দেশের উচ্চশিক্ষাকে রক্ষা করতে হবে। ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের। আধুনিক কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব তো অনেক। সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা, জ্ঞানের ও সৃজনশীলতা বিকাশের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আগামী দিনের দেশ ও বিশ্ব কেমন হবে, তার দিকনির্দেশনা দেবে তো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সেসব প্রত্যাশাই বিষয়-বিশেষজ্ঞ বিশিষ্টজনদের।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক, অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]